রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৫৯ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক :
বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ইকোসিস্টেম বেজড অ্যাপ্রোচেস টু অ্যাডাপটেশন ইন দ্য ড্রাউট প্রোন বারিন্দ ট্র্যাক্ট অ্যান্ড হাওড় ওয়েটল্যান্ড এরিয়া (ইবিএ) নামের মেগা প্রকল্পের বিভিন্ন মেয়াদে ছয় উপপ্রকল্পের বাস্তবায়ন ও সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকল্পগুলোতে ঘটেছে ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতি। অভিযোগ উঠেছে নির্ধারিত খাত অনুযায়ী কাজ না করেই প্রকল্পগুলোর বিপুল অর্থ লোপাট হয়ে গেছে।
তবে প্রকল্প পরিচালক বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ এ প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, প্রকল্পগুলোর কাজ ঠিকমতো না হওয়ায় মাঠপর্যায়ে কোনো সুফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। তাদের পানি সমস্যার সমাধান হয়নি। উন্নতি হয়নি পরিবেশের।
নির্ধারিত খাত অনুযায়ী কাজ না করেই বিপুল অর্থ লোপাট * তিন প্রকল্প সাইটে পুকুর খননের চিহ্ন নেই * পানি সমস্যার সমাধান হয়নি।
জানা গেছে, বরেন্দ্রের অধিক্ষেত্রে গভীর নলকূপ স্থাপন, বিদ্যুতায়ন ও সেচ নালা নির্মাণ, ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ, কৃষি ও কৃষকের দক্ষতা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকরণ, পানি বিতরণ ও প্রিপেইড মিটার স্থাপন, বৃক্ষ রোপণ, অকেজো নলকূপ সচলকরণ, পুকুর পুনঃখনন, খাল খনন ও অন্যান্য কাজসহ ৬ প্রকল্পে মোট ৩৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। কয়েকটি পর্যায়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের কথা ছিল।
ইবিএ প্রকল্প ইউনিট-২ এর আওতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে মোট ৩১ কোটি ১ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ২০০৫ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন দেখানো হয়। এ প্রকল্পের আওতায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বরেন্দ্র এলাকায় নিবিড় বনায়ন, নতুন বন সৃজন ও বিভিন্ন ধরনের গাছের চারা উৎপাদন এবং চারা রোপণ প্রকল্প খাতে বরাদ্দের পুরো টাকা ব্যয় করা হয়। কিন্তু অভিযোগ মতে, আগেকার বৃক্ষ দেখিয়েই প্রকল্পের দুই তৃতীয়াংশ টাকা লোপাট করা হয়েছে।
ইবিএ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন বলেন, এক দশকে বরেন্দ্রভূমিতে কাম্যতার চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় রোপিত বৃক্ষের চারাগুলো খরায় শুকিয়ে মরে গেছে। পুকুর, খাড়ি ও জলাশয়ের পাড়ে কিছু গাছ অবশিষ্ট আছে যেগুলো দুই দশক আগে রোপণ করা হয়েছিল। নতুন কোনো বনরাজি সৃষ্টি হয়নি। ফলে পরিবেশের বিশেষ কোনো উন্নতি ঘটেনি।
এদিকে ইবিএ প্রকল্পের আওতায় ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১৯৯ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে আরেকটি উপপ্রকল্প বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় গভীর নলকূপ সচলকরণ, পানি বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রিপেইড মিটার স্থাপন করার কথা ছিল। এ প্রকল্পের আওতায় পুরাতন গভীর নলকূপগুলো সংস্কার করার কথা থাকলেও নামমাত্র তা সংস্কার দেখানো হয়েছে। ফলে কিছুদিন পর নলকূপগুলো আবার অচল হয়ে পড়ে। পানি বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে নামমাত্র। আর প্রি-পেইড মিটার প্রকল্পের বিপুল অর্থ ব্যয় করা হলেও সেচ বিতরণ ব্যবস্থায় প্রি-পেইড মিটারের ব্যবহার প্রায় নেই বললেই চলে। এখন কৃষকেরা বেশি টাকা দিয়ে দিন ও ঘণ্টা চুক্তিতে সেচের পানি কেনেন গভীর নলকূপ অপারেটরের কাছ থেকে।
নওগাঁর নিয়ামতপুরের ধানসুড়া এলাকার কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বরেন্দ্রের গভীর নলকূপগুলো আশির দশকে স্থাপন করা। এসব গভীর নলকূপের কার্যক্ষমতা আগেই শেষ হয়েছে। অনেক নলকূপে পানি উঠছিল না। সেগুলো সংস্কার করা হয়নি। ফলে অনেক নলকূপ পরিত্যক্ত হয়ে আছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে চাষাবাদ।
অন্যদিকে ২০১৪-১৮ সাল পর্যন্ত রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় পুরাতন গভীর নলকূপ পুনর্বাসন প্রকল্পে ৭৬ কোটি ২২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা বরাদ্দ ও ব্যয় করা হয়। এ খাতেও বিপুল বরাদ্দ লোপাটের অভিযোগ উঠেছে।
ইবিএ প্রকল্পের অধীন ২০২০ সালে ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ এবং কৃষি দক্ষতা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পে ৪৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা ব্যয় করা হয়। ওই প্রকল্পের কাজে শতকরা ৯২ ভাগ অগ্রগতি দেখানো হলেও প্রকল্পটির অর্ধেকও হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগে জানা গেছে, দক্ষতা উন্নয়নের নামে বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও এসব প্রশিক্ষণে কৃষকদের কোনো অংশগ্রহণ হয়নি।
এদিকে ২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নাধীন আরেকটি প্রকল্পে ৪২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বরেন্দ্র এলাকার মজা পুকুর ও খাল খনন করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা। কিন্তু প্রকল্পটি শুরুর ৫ বছর পার হলে বর্তমানে কাজের অগ্রগতি ১০ ভাগের কম বলে বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে। কাজের বিশেষ অগ্রগতি না হলেও বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকের বেশি উত্তোলন করা হয়েছে। সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে সরেজমিন গিয়ে প্রকল্পের কোনো কাজ দেখা যায়নি।
এছাড়া রাজশাহীর তানোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও নওগাঁর সাপাহার এলাকায় তিনটি প্রকল্প সাইটে গিয়েও পুকুর খননের কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। জানা গেছে, প্রতিটি পুকুর খননে ১০ লাখ টাকা করে খরচ দেখানো হয়েছে। পুকুরপাড়ে প্রকল্পের একেকটা সাইনবোর্ডের খরচ দেখানো হয়েছে ৩০ হাজার টাকা করে। তানোরের কৃষক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, লোবাতলা ব্রিজের পূর্ব পাশ থেকে শিবনদী পর্যন্ত ৩ দশমিক ২ কিলোমিটার খাল খনন শেষ করা হয়েছে দায়সারাভাবে। নাচোলের কৃষক কুরবান আলী বলেন, এলাকায় কৃষকরা চরম পানি সংকটে আছেন। বিপুল অঙ্কের ইবিএ প্রকল্পের নামে শুধু লুটপাট করা হয়েছে। ইবিএ প্রকল্পের অধীন সব প্রকল্পের বাস্তব পরিস্থিতি মাঠপর্যায়ে তদন্তের দাবি করেন কৃষকেরা।
ইবিএ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বিএমডিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ বলেন, এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প। বিভিন্ন সময় স্তরে স্তরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। কাজ অনুযায়ী বরাদ্দ অর্থ ব্যয় হয়েছে। প্রকল্পে কোনো অনিয়ম হয়নি। রা/অ