বৃহস্পতিবর, ২১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১৮ pm
ইংরেজ ভদ্রলোক চার্লস কানিংহাম বয়কটের কীর্তিকলাপের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের বর্গাচাষীসহ স্থানীয় লোকজন তাকে একঘরে করার যে কার্যক্রম শুরু করেছিলেন সেই রীতি থেকে বয়কট শব্দটি অভিধানভুক্ত হলো। ১৮৮০ সালে চার্লস কানিংহাম বয়কট আয়ারল্যান্ডের খাজনা আদায়ের দায়িত্বে ছিলেন। সে বছর ফসলের ফলন কম হওয়ায় কৃষকরার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা জেগেছিল। তখন রাষ্ট্রীয় ফরমানে ১০ শতাংশ খাজনা মওকুফের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু কৃষকদের দাবি ছিল ২৫ শতাংশ খাজনা মওকুফ করতে হবে। চাষীদের এ দাবী অস্বীকার করেন লর্ড আর্নে! চার্লস কানিংহাম বয়কট মাতুব্বরি দেখাতে গিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে ১১ জন বর্গাচাষীকে উচ্ছেদের ঘটনা ঘটান।
এর প্রতিবাদস্বরূপ বয়কটের গৃহকর্মী থেকে দিনমজুরেরা বয়কটকে বয়কট করে। ব্যবসায়ীরা তার সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে। এমনকি স্থানীয় ডাকঘরের পিয়নও বয়কটের কাছে চিঠি সরবরাহ বন্ধ করে দেন। বয়কটও কম যাননি। তিনি দূর থেকে শ্রমিক এনে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে জনরোষ আরও প্রকট হতে থাকে। এই ঘটনা ফলাও করে তৎকালের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় এবং তৎকালীন সেটা ভাইরাল হয়। চার্লস কানিংহাম বয়কটকে এই বয়কট কান্ড অভিধানে যুক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে! দাবি আদায়ের হাতিয়ার হিসেবে এখানে-ওখানে বয়কট বয়কট ভালো সংকট সৃষ্টি করেছে।
অতীত ও বর্তমানের বয়কট :
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী গণজাগরণে ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয়েছিল স্বদেশী আন্দোলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বরিশালের চারণ কবি মুকুন্দ দাস, প্রাক-গান্ধী যুগের অরবিন্দ ঘোষ, গঙ্গাধর তিলক এবং লালা লাজপত রায় প্রমূখ ছিলেন এই আন্দোলনের পুরোধা। বৃটিশদের পণ্য ত্যাগ করে স্বদেশী পণ্যের প্রতি নির্ভরতাই ছিল এই আন্দোলনকে সফল করার নেয়ামক । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশমাতৃকার প্রতি ভক্তি জাগাতে রচনা করলেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-গীতটি। যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) এর কার্টুন বিতর্কে ফ্রান্সের পণ্য বয়কটের হিরিক লেগেছিল দেশে দেশে। অতিসম্প্রতি ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গাজা আক্রমনের ফলে মুসলিম বিশ্ব থেকে ইসরাইলী পণ্যসমূহ বয়কটের ডাক এসেছে এবং অনেকটা সফলও হয়েছে। ক্রেতারা পণ্য পছন্দে সচেতন হয়েছে।
বয়কটের অর্থনৈতিক ক্ষতি :
বয়কটের ডাক কেবলই প্রচলিত ট্রেন্ড নাকি অর্থনৈতিক ক্ষতিও হয়? গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও পরিসংখ্যান বলছে, বয়কটে বিরাট ক্ষতি হয়। বিশ্বের এক নম্বর ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডসের প্রধান নির্বাহী ক্রিস কেম্পজিনস্কি চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি হঠাৎ প্রকাশ্য স্বীকারোক্তি দিলেন যে, গাজায় ইসরাইলের অভিযানের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ও তার বাইরে তাঁর কোম্পানির ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। অনুরূপ ক্ষতির কথা স্বীকার করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কফি চেইন স্টারবাকস(প্রথম আলো, ৩০ মার্চ-২০২৪)। ইসরাইলের যে পণ্য বাংলাদেশের বাজারে কয়েক মাস পূর্বেও ১০০ টাকায় হরদম বিক্রি হতো সেই পণ্যের মূল্য ৪০ টাকা হৃাস করে ৬০ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েও মার্কেটে ক্রেতার মন পাচ্ছে না। দেশের বাজারে ফ্রান্স এবং ইসরাইলী পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে এবং বিদেশী বিকল্প কিংবা দেশী পণ্যের ওপর ক্রেতার নির্ভরতা বাড়ছে। শুধু ইসরাইল ও ফ্রান্সের পণ্য নয় বরং ফ্রান্সের ও ইসরাইলের বিতর্কিত কর্মকান্ডের সাথে যারা একাত্মতা পোষণ করেছে, পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের উৎপাদিত পণ্যের চাহিদাও বাজারে ব্যাপকভাবে কমেছে। মূল্যহৃাস করেও তারা বাজার পাচ্ছে না। বাজার পেতে হলে তো ক্রেতার মন পেতে হবে। ক্রেতার মনে তারা নাই। ক্রেতার মনে ফিলিস্তিনের শহীদ শিশুরা জায়গা নিয়েছে।
তরমুজ, গরুর মাংস এবং অন্যান্য পণ্য বয়কট :
দেশের বাজার ব্যবস্থাপনা দিনে দিনে সিন্ডিকেটের কড়াল গ্রাসে চলে যাচ্ছে। যাতে একদিকে উৎপাদক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না, অন্যদিকে ভোক্তাও সামর্থ্যের মধ্যে স্বস্তি নিয়ে বাজার থেকে ফিরতে পারছে না। রমজান মাসে দেশীয় ফল তরমুজের চাহিদা তুঙ্গে থাকে। অথচ বাজারে তরমুজের মূল্য আকাশচুম্বী। রমজানের শুরুর দিকে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হয়েছে ৮০-১০০ টাকা। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদে দেখলাম, তরমুজ উৎপাদনকারী কৃষক জানেই না যে তরমুজ কেজিতে বিক্রি হয়! কৃষকরা ক্ষেত থেকে পাইকারদের কাছে পিছ হিসেবে তরমুজ বিক্রি করে। পাইকারিতে সাইজ হিসেবে দামের কিছুটা তারতম্য হয়। ক্ষেতে যে তরমুজ ১০০-১২০ টাকা সেই তরমুজ ঢাকা এসে ৪০০-৫০০টাকায় বিক্রি হয়। মধ্যসত্ত্বভোগীরা কয়েকগুণ মুনাফা করছে-এই সংবাদ ছড়িয়ে যেতেই সোস্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার দ্বারা তরমুজ বয়কটের ডাক আসে। এতে ক্রেতারাও ব্যাপকহারে সাড়া দিয়েছে। ফলাফলে, বাজারে তরমুজ আছে কিন্তু ক্রেতা নাই! রমজানের শুরুর দিকে যে তরমুজ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই তরমুজের দাম ২০০ টাকায় নেমে এসেছে তবুও ক্রেতাদের উপচেপড়া ভীড় নাই! সম্প্রতি গরুর গোশত বয়কটের ডাক এসেছ! সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য যেভাবে বেড়েছে এবং কোন ব্যবসায়িক নিয়মনীতি না মেনে যেভাবে কসাইরা দাম বাড়াচ্ছে তাতে এই ডাকেও উল্লেখযোগ্য সাড়াদান ঘটবে। তাছাড়া খেঁজুর, মশলার ক্রেতারাও প্রয়োজনটুকুই কিনছে, বিরতও থাকছে!
ভারতীয় পণ্য বয়কট ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট :
সোস্যাল মিডিয়ায় ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক এসেছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধুপ্রতীম, ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল তাদের পণ্যের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাকে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন ব্যাপারে, বিভিন্ন পণ্যে এখনো ভারত নির্ভর। কাজেই ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাকে দেশের নীতিনির্ধারকরা অস্বস্তিতে পড়বে-সেটাই স্বাভাবিক। ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রশ্নে রাজনৈতিক মেরুকরণও জোড়ালোভাবে ভূমিকা রাখছে। ভারতের হুটহাট সিদ্ধান্তের নিত্যপণ্যের রফতানি বন্ধ করে দেওয়ায় এদেশের মানুষকে পিঁয়াজ ৪০০ টাকা কেজি দরে, আলু ৭৫ টাকা কেজিতে কিনে খেতে হয়েছে! যখন দেশীয় কৃষক দু’পয়সা লাভের স্বপ্ন দেখছে তখন আবার পণ্য রফতানির ঘোষণা দিয়ে দেশীয় পণ্যের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে! অর্ধযুগ আগে ভারত বাংলাদেশে গরু দেবে না এমন ঘোষণায় দেশের খামারিদের উদ্যোগে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা সংকটে ভারতের চুপ থাকা, আসামের এনআরসি সংকটে বাংলাদেশকে দোষারোপ করা, সীমান্ত হত্যা বন্ধ না হওয়া কিংবা তিস্তা চুক্তি কার্যকর না করায় এই প্রজন্মের মাঝে ভারত বিদ্বেষ বেড়েছে-এটা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। তাছাড়াও ক্রিকেট বিদ্বেষে, সাপোর্ট বিদ্বেষে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশে রফতানি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তগুলো বুদ্ধিপ্রসূত কি-না সেটাও ভাবা দরকার। ভারত নির্ভরতা নিয়ে দায়িত্বশীল লোকদের কিছু কিছু বক্তব্য ও মন্তব্যও বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বন্ধুপ্রতীম ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক্য সৌহার্দ্যের হোক। বন্ধুত্বে রেষারেষি থাকলে কোন বন্ধুত্বেবর কোন পক্ষই মূলত জিততে পারে না।
বয়কটের সংকট সমাধানের পথ :
ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ এবং অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে যদি সামাজিকভাবে বয়কট করা যায় তবে স্বস্তি ফিরবে। সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দিতে না পারলে বাজারে স্বস্তি আসবে না। তবে এক্ষেত্রে হুজুগে বয়কট হিতে-বিপরীত চিত্র সৃষ্টি করতে পারে। বরং আইনের শাসন, জবাবদিহিতা এবং নৈতিকতার উৎকর্ষের মাধ্যমে উৎপাদকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায় এবং ভোক্তাও তার সামর্থ্যের মধ্যে স্বস্তিসহকারে বাজার নিয়ে বাসায় ফিরতে পারে। এজন্য রাষ্ট্রকে প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। দলীয় বয়কটের সুযোগ দিলে বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের সাথে সম্পর্ক তিক্ত হবে এবং উৎপাদক চাষের আগ্রহ হারাবে। সিন্ডিকেটের মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে না পারলে আজ পণ্যের বিরুদ্ধে বয়কট, আগামীকাল ব্যক্তির বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক আসবে। যা তিক্ততা বাড়াবে বহি কমাবে না। এই যে বয়কটের ডাকে মানুষ সাড়া দিচ্ছে এর কারণ সাধারণের মতামতের সাথে আহ্বানকারীর চাহিদা মিলছে। এটা সুন্দর-সৃশৃঙ্খল সমাজের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। জনমতকে রাষ্ট্রকেই সর্বাধিক প্রাধাণ্য দিতে হবে। উৎপাদক এবং ভোক্তার মাঝখানে যে সকল বাঁধাগুলো পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে, যে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাকে জিম্মি করে-তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বন্ধুপ্রতীম ভারতেকেও বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের পালস বুঝতে হবে। ক্রিকেট রঙ্গের বিষ রক্তের সাথে মেশানো ঠিক নয়। খেলায় পাকিস্তানের সাপোর্ট করলে সেটা ভারত বিরোধিতা হয় এই ভুল অচিরেই ভাঙুক। ভারত তো তরুণ প্রজন্মের হৃদয় জয় করতে পারতো! ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব কৃতজ্ঞতা ও বাস্তবতায় সম-মর্যাদায় বাড়ুক। উপকারী বয়কটগুলো বাঁচুক এবং ক্ষতিকর বয়কটগুলো হারুক। কলাম লেখক, সূত্র : [email protected]