শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০২:২২ pm
বাহিরে হাসি দেখানো আর ভেতরে ভালো থাকা-ঢের তফাৎ আছে। সময়ের প্রয়োজনে, নিত্যাকার জীবনযাপনে কতরকমের অভিনয় করতে হয়! ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তবুও বলতে হয়-এইতো বেশ ভালো আছি। পারিপার্শ্বিকতা নানাভাবে দুঃখ দেয়, প্রিয়জন আঘাত করেই সুখ পায় কিংবা প্রয়োজন স্বার্থের টানে দূরে যায়-এভাবেই ব্যথার তরী ভরে ওঠে। শত বেদনার মাঝেও নানান পোশাকে সাজতে হয়, বাহারি ঢঙে ছবি তুলতে হয় কিংবা নানা ভাঁজের কথা বলতে হয়! আদতে ভালো না থাকলে এই সমাজ-সভ্যতার কিছু যায়-আসে না কিন্তু ভালো না থেকেও যদি ভালো থাকার অভিনয় না করেন তবে সবাই তিক্ত কথায় জাপটে ধরে, খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তৃপ্তি খোঁজে কিংবা পাছের কথায় ঝড় ছোটাবে!
সমাজ-সংসার বাহির দেখে বিচার করে! ভালো থাকা, না থাকা যে ভেতরে থাকে সে বুঝ ক’জনে বোঝে? দরদ আর ক’জনে ধরে! আঘাত করতে করতেও কামনা করে আঘাতপ্রাপ্ত পৃথিবীকে জানাতে বলুক-ভালো আছি! সবাইকে দেখিয়ে দিক-সুখে আছি! অথচ ভেতরটা দেখানো যায় না। কখনো কখনো দেখানো হয় না! কাউকে কাউকে দেখাতে ইচ্ছাও করে না! কেউ কেউ দেখতেও চায় না বা পায় না। সমাজ বাহ্যরূপ দেখে মানুষের বিচার করে বলে চিরদুঃখীজনও ভালোর ছদ্মবরণে সমাজকে ঈর্ষান্বিত করে রাখতে চায়! আসলেই ভালো আছি-এটা সমাজস্থদের হিংসার মহান কারণ! কেউ মহাদুঃখে আছে-সমাজ এমন কাউকে পেলে খুব সন্তুষ্ট হয়! বেদনার বড় বড় পাহাড় সেখানে চাপিয়ে দিয়ে মহানন্দ পায়! সমাজের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে তাই ভালো থাকার অভিনয় এই এখানে নতুন কিছু নয়।
সেজন্যই বাথরুমে জড়ানো অশ্রুফোঁটার খোঁজ বেডরুমের সহবাসী বহুলাংশেই জানে না। একাকীত্বের যাতনা আড্ডায় কেউ কোনদিন তোলে না। বৃষ্টির সাথে মিশে যায় চোখের পানি! বালিশ শুঁষে নেয় যে নোনাজল সেটাই আসল আপনি-আমি! দুঃখগুলো কেউ ধরে ফেলুক, নিজস্বতা কেউ জেনে যাক-বাধ্য না হলে এসব কাউকে কখনোই জানানো হয় না। জীবনটা মানাতে মানাতে চলে যায়। রেখে যায় স্মৃতিচিহ্ন! যার পদাঙ্ক অনুসরণ করে কেউ খোঁজে না। যে দুঃখের কেউ ভাগীদার হয় না, যে ব্যথায় কেউ মমত্বের স্পর্শ দেয় না কিংবা সুজন হয়ে স্বান্তনার অংশীজন পর্যন্ত হয় না, সেখানে কষ্ট-ব্যথার হাঁটবার বসালে কেউ দরদাম করার প্রয়োজনও মনে করবে না! প্রয়োজনের পৃথিবীতে প্রিয়জনের সাথে জ্যোছনা দেখা, বারিষ ছোঁয়া কিংবা নদীর তীরে হাঁটা-এমন সৌভাগ্য খুব কম মানুষের হয়!
ভুল মানুষের সাথে বেদিক যাত্রা করে আফসোসে বলি-ভুল হয়ে গেছে বিলকুল! জীবনে দুঃখ জড়ো হতে থাকে! এক পাহাড় দুঃখ থেকে দু’টো দুঃখ কাউকে বিশ্বাস করে তুলে দিয়ে দুঃখ আরও বাড়াই! কেননা শখের বেপারি দুঃখ নিয়ে কারবার করতেই ভালোবাসে! সে জিম্মি করে, সুযোগে দুর্বলতায় আঘাত হানে! লোকে লোকে বলে-অমুকের এমন দুঃখ, তমুকের তেমন! সুখের রাজ্য থেকে সুখ কুড়ানোর হাতের অন্ত নাই কিন্তু দুঃখ নেওয়ার ভাগীদার ধরাধামে জোটে না! কাজেই দুঃখগুলো বুকের বামপাশে খুব যতনে জমা রেখে রোজ একচিলতে লম্বা হাসিতে বলতেই হয়-ভালো আছি! তোমরাও ভালো থেকো। আমি যে সুখী-নানান কসরতে সেটা জানাতে হয়! মিথ্যার বেসাতিতে ভালো থাকার গল্প সাজাতে হয়! যদি ধরা পড়ে যাই-এই ভয়ে মুখের সারল্য বাড়াতে হয়! দুঃখ এখানে পাপ! পাপ দেখানো আরও বড় পাপ! কাজেই মিথ্যা সুখে জীবন উৎসর্গ করতে হবে! ভালো আছি-বলে বলে জিহ্বার তেজ বাড়াতে হবে!
একদিন ঠিক ধরা পড়ে যায় মনের খবর! জানাজানি হয়, অতঃপর রচিত হয় কবর! সাহসীরা স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে লয় আর দুর্বলরা নিত্যদিনে কয়েকবার করে মরে। সুখের ভান ধরে আর বহ্নিশিখায় পুড়ে! ভালো নাই-কেন এই সত্য মানুষ স্পষ্টভাবে বলতে পারে না? সত্য বলতে পারলে বুকের ভেতরটা হালকা হতো! ফলকা হয়ে একসাগর দুঃখ শুঁকিয়ে যেতে পারতো! অথচ সমাজ শেখায়-দুঃখকে যতভাবে পার লুকিয়ে রাখো! মিথ্যার মোড়কে, অসত্যের মুখোশে বারবার ভালো থাকার কথা বলো! সমাজের এই মন্দ নীতি মিথ্যা গীতিতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে! এখানে হেরেও বলতে হবে জিতে গেছি! মরেও বলতে হবে বেঁচে আছি! অথচ সাধারণ সুন্দর হতে পারতো! ভেতর-বাহিরের সম-আমি মুক্তিকামী-স্লোগানে স্লোগানে সত্যের জয় হতে পারতো। হয় না, কেন হতে দেই না-সেসব জানি না! জানলেও প্রথাভাঙা মানি না! কেমন আছ? ভালো আছি!-বলতে বলতে জীবনের ক্ষান্ত খুঁজি! কলাম লেখক, সূত্র : [email protected]