শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:১০ am
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীর হাট-ঘাট, পুকুর-দিঘি, বিল-জলাশয় ইজারার প্রক্রিয়া শেষের পথে। তবে প্রতিবছর বাংলা সন শুরুর আগে এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি আদালতে ছোটাছুটি শুরু করেন। টাকা-পয়সা ঢেলে আদালতের একটা কাগজ নিয়ে ছুটে যান উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনারের কার্যালয়ে। উদ্দেশ্য যে কোনো উপায়ে খাস পুকুরের ইজারা ঠেকানো। এই প্রক্রিয়ায় খাসপুকুর ইজারা না হওয়ায় বছরে শতকোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।
জাল দলিল সৃজন ও জাল কাগজপত্র তৈরি করে উচ্চ আদালত থেকে কোনোভাবে একটা অন্তর্র্বতী আদেশ এনে যুগের পর যুগ ধরে রাজশাহীর হাজার হাজার সরকারি খাস পুকুর-দিঘি ও জলাশয়ের ইজারা প্রক্রিয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। এভাবেই বছরের পর বছর অবৈধভাবে ভোগ দখল করা হচ্ছে পুকুর, দিঘি, জলাশয়। অবৈধভাবে ভোগ দখলে এলাকায় এলাকায় গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটে রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। ভূমি বিভাগের কর্মচারীরাও সিন্ডিকেটের ভেতরে রয়েছেন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসনের ভূমি রাজস্ব বিভাগের সূত্রে জানা যায়, নিলাম ডেকেও রাজশাহীর কয়েক হাজার খাস পুকুর জলাশয় শেষ মুহূর্তে ইজারা দেওয়া যায় না। কারণ জাল দলিল সৃজন করে পুকুর সিন্ডিকেটের সদস্যরা ওইসব দলিল উপস্থাপন করে উচ্চ আদালতে রিট করেন। আদালত তাৎক্ষণিভাবে দলিলের বৈধতা ও সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেন না। রিট মামলার পরিপ্রেক্ষিতে একটা অন্তর্র্বতীকালীন আদেশ জারি করেন। সারা বছরে এসব রিটের আর কোনো খোঁজখবর থাকে না। সরকারি ভূমি বিভাগও এসব রিট নিষ্পত্তির বিষয়ে মনোযোগী হয় না। ফলে শুধু একটা অন্তর্র্বতী আদেশ নিয়ে রিটকারী বছরের পর বছর ধরে সরকারি পুকুর-দিঘি, জলাশয় দখলে রেখে ভোগ করছেন। জেলার গোদাগাড়ীতে রয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সরকারি খাসপুকুর। এর আয়তন মোট ২ হাজার ৫৮০ একর। গোদাগাড়ীতে ২০ একর আয়তনের কম খাস পুকুরের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৫৭টি। অন্যদিকে ২০ একরের বেশি আয়তনের খাসপুকুর দিঘি জলাশয় রয়েছে শতাধিক। আদালতের অন্তর্র্বতী আদেশের ফলে প্রায় অর্ধেক খাস পুকুর ইজারা দিতে পারেন না উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার।
সূত্র জানায়, গোদাগাড়ীতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের একটি সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে খাস পুকুর ইজারায় কারসাজি করে আসছে। ইজারা নিতে এলাকায় এলাকায় তৈরি করা হয়েছে শতাধিক ভুয়া মৎস্যজীবী সমিতি। এসব কাগুজে সমিতিতে নেই প্রকৃত কোনো মৎস্যজীবী। মৎস্যজীবীরা পুকুর সিন্ডিকেটের কাছ থেকে চড়া দামে পুকুর কিনে মাছ চাষ করেন। কৌশলে খাস পুকুর দখলে নিয়ে গোদাগাড়ীতে ক্ষমতাসীন কয়েকজন নেতা গত কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিপুলসংখ্যক খাস পুকুর বেহাত থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আতিকুল ইসলাম বলেন, আদালতের আদেশের ফলে কিছু পুকুর আমরা ইজারা দিতে পারছি না। এসব পুকুর ইজারার বিপরীতে বিভিন্ন আদালতে যেসব মামলা করে রাখা হয়েছে সেগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা করছি।
এদিকে রাজশাহীর পুঠিয়ায় খাস পুকুরের সংখ্যা ১৫৫টি। কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ১১টি খাস পুকুর ইজারা দেওয়া যায়। বাকি ১৪৪টি অনেক বছর ধরে ইজারা দিতে পারে না সরকার। এসব পুকুরের আয়তন ৩১৯ একর। পুঠিয়ার পুকুর জলাশয়গুলো আকারে বড় আয়তনের। অন্যদিকে রাজশাহীর বাগমারায় ৫৭৮ একর আয়তনের খাস পুকুর রয়েছে ৮৪৯টি পুকুর ও ১৫টি বিল রয়েছে। এর মধ্যে ২৬০টি খাস পুকুর অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে নথিভুক্ত। এসব পুকুর ও বিলের অধিকাংশই বহু বছর ধরে বেদখল হয়ে আছে। ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের সিন্ডিকেট এসব খাস পুকুর ইজারা বাধাগ্রস্ত করে মৎস্যজীবীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাগমারায় সরকারি এসব খাস পুকুর ও সরকারি বিল দখল নিয়ে সংঘর্ষে গত কয়েক বছরে কয়েকজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
তানোরে রয়েছে ৬৪৪ একর আয়তনের ৮৩৭টি খাস পুকুর ও খাড়ি। এসব পুকুরের মধ্যে বেশিরভাগই অবৈধ দখলে রেখেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের একাধিক সিন্ডিকেট। জেলার দুর্গাপুরে ৫৪১ একর, চারঘাটে ৩৪৬ একর বাঘায় ১ হাজার ১৮৬ একর, মোহনপুরে ২১২ একর এবং পবা উপজেলায় রয়েছে ৭৩৯ একর খাস পুকুর। গত ১০ বছরের বেশি সময় ধরে এসব খাস পুকুর ও জলাশয় ইজারা দিতে পারছে না সরকারি দপ্তর।
অভিযোগ রয়েছে, শত শত খাস পুকুর প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় এসব পুকুরের পানি ব্যবহার থেকে বঞ্চিত বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা। প্রভাবশালীরা এসব পুকুরের পানি জমিতে কৃষকের সেচ দিতে দেয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দখলদাররা কৃষকের কাছে এসব পুকুরের পানি বিক্রিও করে থাকেন। অথচ সরকারি এসব পুকুরের পানি ব্যবহার উন্মুক্ত থাকার কথা। এলাকার মানুষ গৃহস্থালি ও পশুপালনে আগে এসব পুকুরের পানি ব্যবহার করতে পারতেন। বেদখল থাকায় এখন এলাকাবাসী পুকুরগুলোতে নামতে পারেন না।
জানতে চাইলে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, আইনি জটিলতায় কিছু খাস পুকুর ইজারা দেওয়া সম্ভব হয় না। সরকারি আইন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রিটগুলো নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। সূত্র : যুগান্তর