শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:১১ am
ডেস্ক রির্পোট :
উত্তরাঞ্চলের অন্যতম সবজির পাইকারী মোকাম রংপুর নগরীর সিটি বাজারে বিভিন্ন ধরনের সবজির দাম অনেক কমলেও সাধারণ ভোক্তারা এর কোন সুফল পাচ্ছেনা। প্রান্তিক পর্যায়ে একটি ফুলকপি ও বাঁধাকপি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫ টাকা দরে। সেটি তিন হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে।
একই ভাবে ১০ টাকা কেজির টমেটো ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে ৪০ টাকা কেঁজি দরে। এ ছাড়াও বেগুন , কাঁচামরিচ, আলু সহ অন্যান্য সব্জির দাম কমে গেলেও ভোক্তারা এ সুবিধা পাচ্ছেনা। বরং তাদের ৩/৪ গুন দামে ভরা মৌসুমেও সব্জি কিনতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর কোন কার্যকর ভূমিকাই পালন করছেনা বলে অভিযোগ সাধারণ ভোক্তাদের।
মাঠ পর্যায়ে ও পাইকারী সবজি বাজার সরেজমিন ঘুরে কৃষক আড়তদার, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেল চাঞ্চল্যকর নানান তথ্য। পুরো সবজি বাজারটাই কয়েকজন সিন্ডিকেট চক্রের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তারা ইচ্ছে মতো মূল্য নির্ধারন করে, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রংপুরে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে আলু উৎপাদনে রংপুর দেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ আলু উৎপাদনকারী জেলা। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের শাক সব্জি প্রচুর পরিমানে চাষ হয়। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের অনেক জেলার চাহিদা পুরন করে। এ জন্য রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদীপুকুর, দমদমাবাজার, শঠিবাড়ি , রংপুর সদরের পালিচড়া সহ অন্তত ১০টি স্থানে সব ধরনের সবজির পাইকারী বাজার বসে। এখান থেকে ট্রাকে করে রংপুর সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কিনে নিয়ে যায়।
সরেজমিন সব্জির পাইকারী বাজার বলদীপুকুর ও শঠিবাড়িতে ঘুরে দেখা গেছে, ফুলকপি ও বাঁধাকপি প্রতি পিচ এক কেজির উপরে ৪ থেকে ৫ টাকা , টমেটো ১০ টাকা , বেগুন মোটা ৩০ টাকা , কাাঁচামরিচ ৪০ থেকে ৪৫ টাকা, আলু ২০ টাকা , শসা ২০ টাকা, করোলা ৪০ টাকা, মুলা ১০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছে প্রান্তিক পর্যায়ের সব্জি চাষিরা।
এ ব্যাপারে সব্জি চাষি সালেক মিয়া, আব্দুল্লা জানালেন, তাদের বাড়ি মিঠাপকুর উপজেলার বৈরাগীগজ্ঞ ও পায়রাবন্দ এলাকায়। তারা বলেন, ফুলকপি ও বাঁধা কপি সিজন শেষ সে কারনে দাম একেবারে কমে গেছে। চাহিদার আগের মতো নেই। ফলে তারা তাদের মাঠে থাকা ফুল কপি আর বাঁধা কপি ক্ষেত থেকে তুলে ফেলছেন কিন্তু এখন চাহিদা পাইকারদের কাছে না থাকায় ৪/৫ টাকায় একটি করে বিক্রি করছেন তারা। যেহেতু সিজন শেষ সে কারনে অন্যান্য সব্জি বিশেষ করে কাঁচামরিচ, পটল , শসা, সীম , সহ অন্যান্য সব্জি চাষাবাদ করছেন। তারা আরো জানান আমরা যারা প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক আমরা আমাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য মুল্য পাইনা। এটা আড়তদার, পাইকাররা আমাদের বছর ব্যাপি ঘাম ঝড়ানো চাষ করা সব্জি তারা কিনে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করছে।
একই কথা জানালেন পালিচড়া এলাকার সব্জি চাষি সালেহা বেগম, আব্দুর রহমান সহ অনেকেই। তারা বললেন মুলত আগাম সবজি চাষ করে প্রথম দিকে আমরা কিছুটা লাভবান হলেও এখন পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা।
রংপুরের সিটি বাজারের আড়তদার ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার রংপুর অঞ্চলের রংপুর লালমনিরহাট, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে ব্যাপক ভিত্তিতে পেয়াজ চাষ হয়েছে। একই ভাবে কাঁচা মরিচ সহ অন্যান্য সব্জিও চাষাবাদ হচ্ছে। এছাড়াও দেশের মেহেরপুর , কুষ্টিয়া , বগুড়া সহ রংপুর জেলায় ব্যাপক ভাবে পেয়াজের চাষ হয়েছে। চাহিদা মিটিয়ে এবার অন্য জেলাতেও যাচ্ছে পেয়াজ। তা ছাড়া দেশী পেয়াজের ঝাজ ভারতীয় পেয়াজের চেয়ে বেশী। আর মানগত ভাবে দেশীয় পেয়াজ অনেক ভালো। এখন আড়ত গুলোতে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি। প্রান্তিক পর্যায়ে ৬০ টাকা কেজি। তবে খুচরা বাজারে এখনও একশ টাকা দরে পেয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় পেয়াজের চাহিদা একেবারে নেই ফলে আমদানী করার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেন আড়তদার ব্যাবসায়ী রোস্তম আলী সহ অন্যান্যরা।
যে ভাবে সিন্ডিকেট করছে ব্যবসায়ীরা: প্রান্তিক পর্যায়ে সব্জির বাজার থেকে ৫ টাকা দিয়ে ফুল কপি আর বাঁধা কপি কিনে প্রথমে নিয়ে আড়তদাররা। তারা প্রতি পিসি কপিতে ৮ থেকে ১০ টাকা মুনাফা করে বিক্রি করেন পাইকারী সবজি বিক্রেতাদের কাছে পাইকারী ব্যবসায়ীরা কেজিতে ৫/৭ টাকা মুনাফা করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। ফলে তিনহাত হয়ে ৫টাকার সব্জি ৩০ থেকে ৪০ টাকায় ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে ফলে সাধারন ভোক্তারা সব্জির দাম কমলেও এর কোন বেনিভিট পাননা।
নাম প্রকাশে অনিশ্চুক আড়তদারের কর্মচারী জানান, সিন্ডিকেটটা হচ্ছে আড়তদারা তারা পুরো বাজার নিয়ন্ত্রন করে ভোক্তাদের জিম্মি করছেন। এবার ভরা মৌসুমে সব্জি কাঁচা মরিচ, আলু বিক্রি করে রংপুর সিটি বাজারের ৪ সিন্ডিকেট আড়তদার কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে আড়তদার শরিফুল দাবি করেন তারা নাকি ১টাকা কেজিতে মুনাফা করে সব্জি পাইকারী ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। কিন্তু তারা কত টাকা দিয়ে কিনেছেন তা বলেননা এমনকি তার কোন কাগজও দেখাতে পারেননি।
পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতারা যা বলেন: রংপুর সিটি বাজারের পাইকারী সবজি ব্যবসাযী শাহ আলম বলেন, কাঁচামরিচ আমরা ৬০ টাকা কেঁজি দরে বিক্রি করছি কিনেছি ৫৫ টাকা কেজি দরে, টমেটো ২৫ টাকা , আলু ২৮ টাকা দরে বিক্রি করছি। একই ভাবে পেয়াজ ৮০ টাকা দরে কিনে ৯০ টাকা দরে বিক্রি করি। ২০ গজ দুরে সিটি কাাঁচাবাজারে প্রতিটি সব্জির দাম আড়তদার , পাইকারদের থেকে অনেক বেশী তারা ৩/৪ গুন বেশী দরে বিক্রি করছেন। সব্জির বাজারে আড়তদার , পাইকার , এমনকি খুচরা বিক্রেতা কোথাও পন্যের মুল্য তালিকা টানানো নেই কত দামে কেনা এবং বিক্রি তা উল্লেখ করা হলেও ভোক্তারা কিছুটা লাভবান হতো কিন্তু এসব নিয়ে প্রশাসন ও ভোক্তা অধিদপ্তর কারো মাথা ব্যাথা নেই।
তবে আড়তদার ও পাইকাররা বললেন, রমজান শুরুর আগে রোববার থেকে প্রতিটি পণ্যের দাম বাড়বে। বিশেষ করে কাঁচামরিচ, পেয়াজ, টমেটো, শসা , আলু আর বেগুনের দাম বেড়ে যাবে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি আড়তদার আর পাইকাদের গোডাউনে ঘুরে দেখা গেছে বিপুল পরিমান বিভিন্ন ধরনের সব্জি মজুত আছে। শুক্রবার এক দাম রোববার বা সোমবার রোযার আগের দিন প্রতিটি পন্যের দান ২/৩ গুন তারা বাড়িয়ে ২৪ থেকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবেন।
সাধারণ ভোক্তাদের বক্তব্য: রংপুর সিটি বাজারে সব্জি কিনতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম বললেন, আমাদের বেতন বাড়েনি কিন্তু প্রতি নিয়ত নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের দাম বাড়ছে ফলে আমাদের কুলানো যাচ্ছেনা। বাধ্য হয়ে কম পন্য কিনে খেতে হচ্ছে। তার পরেও প্রতি মাসে আমাদের ধার দেনা করতে হচ্ছে। সরকারের মন্ত্রীরা যে ভাষায় কথা বলেন তারা বাজার করেন বলে মনে হয়না। তারা বলেন আমরা ভালো আছি। ভালো থাকার নমুনা যদি এই হয় একেক সময় একেক দামে পন্য কিনে আমরা জিম্মি হচ্ছি সরকারের প্রশাসন যন্ত্র কাজ করেনা।
একই কথা বলেন নির্মান শ্রমিক মমতাজ ও নুরু মিয়া। তারা বললেন ৫শ টাকা মজুরী পাই প্রতিদিন তরকারী কিনতেই ২শ টাকা চলে যায় তার পর চাল সহ আরো প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে হয়। মাসে একদিনেও মাংস কিবা বাটা মাছ যা ১শ টাকা কেজি অন্যান্য খাবার কোন উপায় নেই। তার উপর ঔষধ সহ সংসারে নানান খরচ কিভাবে চলছি আসলে আমাদের নিয়ে কেউই ভাবেনা। যারাই ক্ষমতায় আসে তারা কেউই প্রান্তিক হতদরিদ্র নিম্নবিত্তদের নিয়ে ভাবেনা।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তর রংপুরের প্রধান সহকারী পরিচালক মোস্তাফিজার রহমান দাবি করলেন তারা সার্বক্ষনিক নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের বাজার মনিটারিং করেন। প্রায়শই অভিযান পরিচালনাও করছেন। কিন্তু ভোক্তাদের স্বার্থে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের মুল্য বৃদ্ধির পেছনে কারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। রা/অ