রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:২৭ am
আশরাফুল ইসলাম রনজু :
বেশ কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ ভাগের বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে এসব এলাকায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ব্যক্তি মালিকানায় আরও ৩০ গভীর নলকূপের অনুমোদন দেওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বিরাজ করছে ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
জানা গেছে, ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক মাঠ সমীক্ষায় খাবার ও সেচের পানির মারাত্মক সংকটের উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, চলমান জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব ছাড়াও নির্বিচার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণেই এমন সংকটজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন বন্ধে আরও গভীর নলকূপ স্থাপনের সুযোগ না দেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে সরকারের উচ্চ মহলে।
এদিকে, জরিপে এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এলেও সম্প্রতি রাজশাহীর তানোর উপজেলা সেচ কমিটি ব্যক্তিগত মালিকানায় আরও ৩০টি গভীর নলকূপ স্থাপনের লাইসেন্সের সুপারিশ দিয়েছে। এ নিয়ে এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ, সুপারিশকৃত এসব গভীর নলকূপ ব্যক্তিগত মালিকানায় বাণিজ্যিকভাবে সেচ বিক্রির কাজে ব্যবহার করা হবে। যদিও কাগজপত্রে এসব গভীর নলকূপ ক্ষুদ্র ও কৃষি ভিত্তিক শিল্পের কথা বলে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। গবেষণা সমীক্ষায় যদিও বলা হয়েছে তানোর উপজেলা এলাকার ভূগর্ভের পানিস্তর বছর বছর নিচে নামছে। আরও গভীর নলকূপ স্থাপন করা হলে ভূগর্ভের পানিস্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যমান সেচ আইনে বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার গভীর নলকূপ স্থাপন পুরোপুরি অবৈধ ও বেআইনি। এরপরও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সেচ কমিটি এ বেআইনি কাজের অনুমতি দিয়েছে।
উল্লেখ্য, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদাধিকার বলে উপজেলা সেচ কমিটির সভাপতি। বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী সেচ কমিটির সদস্য সচিব। সেচ কমিটির সভাপতি ছাড়াও সেচ কমিটির কয়েকজনের বিরুদ্ধে এসব অবৈধ অনুমোদনের জন্য মোটা অংকের টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, তানোর উপজেলাজুড়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ৫২৯টি সরকারি গভীর নলকূপ বিদ্যমান রয়েছে। গত ১০ বছরে এর বাইরে তিন হাজারের অধিক গভীর ও সেমি-গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। বিদ্যমান সেচ আইন অনুযায়ী বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে ব্যক্তি মালিকানার গভীর নলকূপ স্থাপনের কোনো সুযোগ না থাকলেও উপজেলা সেচ কমিটিকে ম্যানেজ করেই এসব বেআইনি কর্মকাণ্ড চলে আসছে। বিএমডিএ থেকে মাঝে মধ্যে আপত্তি তোলা হলেও তানোরে থেমে নেই ব্যক্তি মালিকানার গভীর নলকূপ স্থাপন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, এবারে যে ৩০টি গভীর নলকূপের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে তার প্রতিটির জন্য সেচ কমিটিকে ৫ লাখ টাকা করে ঘুস দিতে হয়েছে মালিকদের। ঘুসের এ টাকার মধ্যে প্রতিটির জন্য ৩ লাখ টাকা করে নিয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাদের একটি চক্র। তারা স্থানীয় এমপির নামে এই টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনের এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী এসব গভীর নলকূপের লাইসেন্স দেওয়া ব্যাপারে শুরু থেকেই বিরোধিতা করেছেন। এরপরও ইউএনওরা সেচ কমিটির সভাপতির ক্ষমতায় ঘুষের কারবারে এসব নিয়ম ও দূর্নীতি করে চলেছেন।
বাকি দুই লাখ টাকা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সেচ কমিটির অন্য সদস্যরা ভাগ করে নিয়েছেন। যদিও অনুমোদন প্রদানকারী তানোরের বিদায়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
জানা গেছে, রাজশাহীর তানোরে পোল্ট্রি খামার ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের নামে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচ বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার সেচ বাণিজ্য করছেন এক শ্রেণির লোক। ভয়ংকর পরিবেশগত প্রতিকূলতার সৃষ্টি হলেও ব্যক্তি মালিকানায় গভীর নলকূপ দেওয়া হচ্ছে। এবারে অনুমোদন পাওয়া ৩০টি গভীর নলকূপও বিভিন্ন ক্ষুদ্র শিল্পের নাম করে নেওয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দিতেই ক্ষুদ্র শিল্পের নাম করে গভীর নলকূপ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে যা বাস্তবে সঠিক নয়। শতভাগ ব্যক্তি মালিকানার গভীর নলকূপ থেকে সেচ বিক্রি করা হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে। সাশ্রয়ী হারে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে সেচ বিক্রি করে মালিকরা কোটি কোটি টাকা বিদ্যুৎ বিল ফাঁকি দিচ্ছে।
এবিষয়ে বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, মালিকরা কাগজপত্রে ক্ষুদ্র ও কৃষি শিল্প দেখানোর কারণ এসব খাতের বিদ্যুৎ বিল ইউনিট প্রতি ৪ টাকা ২৫ পয়সা। অন্যদিকে বাসা বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ৫০ পয়সা। রাজশাহী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ও নেসকো এসব সংযোগ দিয়ে আসছে নির্বিচারে। পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য জানেন কিনা তা আমরা বলতে পারছি না বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর এলাকা বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৮৫ সাল থেকে বরেন্দ্র এলাকাজুড়ে গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের পানি তুলছে বিএমডিএ। ওয়ারপোর মাঠ সমীক্ষায় বরেন্দ্র অঞ্চলের দুটি এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর একটি হচ্ছে রাজশাহীর তানোর ও অন্যটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এলাকা।
জানা গেছে, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী এলাকা দুটি অতি উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। এসব এলাকার মধ্যে বছরের তানোরের মুণ্ডুমালা এলাকায় বছরের ৯ মাসই পানির সংকট বিরাজ করছে। গবেষণায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সীমাবদ্ধ করার সুপারিশ করা হলেও উপজেলা সেচ কমিটি আরও ৩০টি গভীর নলকূপের লাইসেন্স অনুমোদন দেওয়ায় বিদ্যমান সংকট আরও বাড়বে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
এব্যাপারে জানতে চাইলে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আব্দুর রশিদ বলেন, বিএমডিএর অধিক্ষেত্রে বিশেষ করে তানোরের মতো সংকটাপন্ন এলাকায় আরও গভীর নলকূপ স্থাপনের অনুমোদন দেওয়ার সুযোগ নেই। উপজেলা সেচ কমিটি কেন কিভাবে এসব অনুমোদন দিয়েছেন বিএমডিএ তা খতিয়ে দেখবে বলে জানান তিনি। রা/অ