শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:৪৫ am
ঢাকা-১৯ আসন থেকে ডা. এনামুর রহমান নির্বাচন করে হেরেছেন। তিনি ছিলেন সদ্য বিদায় নেওয়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী। কঠিন প্রতিযোগিতার পর অল্প ব্যবধানে হার নয়। নির্বাচনের ফলাফলে তার অবস্থান তৃতীয়। একেবারেই আলোচনায় না থাকা, রাজনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলা নেতা না হওয়ার পরও স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলামের কাছে ২৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন সাবেক এই প্রতিমন্ত্রী। সবার ধারণা ছিল, সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মুরাদ জং ও বর্তমান প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে আলোচনায় না থাকা স্বতন্ত্র প্রার্থী সাইফুল ইসলাম চমক দেখিয়ে জয়ী হয়েছেন। হেরেছেন প্রতিমন্ত্রী।
ডা. এনামুর রহমান পেশায় ডাক্তার। সাভারের সুপরিচিত এনাম মেডিক্যাল কলেজের মালিক। ২০১৩ সালে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাভারে ধসে পড়া রানা প্লাজায় শত শত হতাহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়। দশম জাতীয় নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। বিএনপি-জামায়াত জোটের বর্জনের সেই নির্বাচনে জনপ্রিয়তার পরীক্ষা দিতে হয়নি এনামুরকে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে সংসদে আসেন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তিনি জয়ী হন, বিএনপি নির্বাচন থেকে শেষ পর্যায়ে সরে যাওয়ার কারণে সেই নির্বাচনেও ছিল না প্রতিযোগিতা। তাই জনপ্রিয়তা যাচাই করা সুযোগ হয়নি। জিতে আসার পর মন্ত্রিসভায় করা হয় প্রতিমন্ত্রী। এরপর তিনি আরও জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে যান।
সাইফুল ইসলাম জয় পেয়েছেন শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ার শ্রমিকদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক, করোনার সময় শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানো এবং অন্যান্য স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সুসম্পর্কে কারণে। যার সবক’টির ঘাটতিই ছিল সাবেক প্রতিমন্ত্রীর।
হবিগঞ্জ-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনের কাছে প্রায় এক লাখ ভোটের ব্যবধানে হেরেছেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তিনিও ২০১৪ সালে বিনা ভোটে নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালেও তাকেই মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। তিনি জয়ী হয়ে আসেন। কারণ, তখন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন খেলাফত মজলিসের প্রার্থী। সাবেক এই মন্ত্রীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি জনপ্রিয়তার পাল্লা যাচাই করার। জনবিচ্ছিন্নতা আর স্বজনপ্রীতির কারণে বিপুল হার হয়েছে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছে এলাকাবাসী।
যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর কাছে হেরেছেন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য্য। তিনি এই আসনে ২০১৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ও ২০১৮ সালে নৌকার প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্যের দুই মেয়াদে মণিরামপুরে কোনও কাজে আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীদের কোনও স্থান ছিল না। অভিযোগ আছে, তারা ছিলেন অবহেলিত। প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের পছন্দের বাইরে পাঁচ বছরে মণিরামপুর উপজেলার কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেউ নিয়োগ পাননি। তিনি ও তার স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। নেতারা জানান, মণিরামপুরে জামায়াত-বিএনপিকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং তাদের লালন-পালন করেছেন স্বপন ভট্টাচার্য।
এই ৩ মন্ত্রীসহ নৌকা পেয়েও হেরেছেন ২৬ জন সংসদ সদস্য। নৌকা নদী পার করাতে পারেনি তাদের। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন আওয়ামী লীগের ১৬ জন সংসদ সদস্য। তাদের মধ্যে ১৩ জনই হেরেছেন। এর মধ্যে ৩ জনের জামানতই বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তারা সবাই ২০১৮ সালে বিপুল ভোটে জিতে যাওয়া সংসদ সদস্য।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মোট ৩৯ জন সংসদ সদস্য হেরেছেন। অথচ ছিল না অন্য কোনও বড় দলের প্রার্থী। হারার কারণ কম-বেশি একই, জনবিচ্ছিন্নতা, দলীয় নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন না করা আর স্বজনপ্রীতি। এসব কিছুই তারা করেছে। কারণ, তারা জানতেন জনগণের কাছে জবাবদিহি না করলেও চলবে। কেন্দ্রকে খুশি রাখলেই পাওয়া যাবে নৌকায় ওঠার টিকিট। আর নৌকায় উঠলেই হবে নদী পার। ২০১৪ আর ২০১৮-এর নির্বাচনই তাদের এই ধারণার মূল ভিত্তি। নিজ মাটি আর মানুষের সঙ্গে রাজনীতি করা মানুষ হারে খুবই কম। কিন্তু নানা পেশা থেকে হঠাৎ সংসদ সদস্য হওয়া নেতারা ঠিক বোঝে না বা বুঝতে চায় না তাদের ক্ষমতার কেন্দ্র জনগণ। এবার আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রী তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন অল্প হলেও। অনেক সমালোচনা-আলোচনার বাইরে, সব দল নির্বাচনে অংশ নিলে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা কত বড় বিপদে পড়বেন তার একটা পূর্বাভাসই ছিল এই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। লেখক : সাংবাদিক, সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন