শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০১:২৮ pm
‘আমার সন্তান মারা গেছে, আমার স্ত্রী মারা গেছে, আমি আর বেঁচে থেকে কী করবো’-চোখের সামনে পুড়ে যাওয়া মানুষটির আত্মচিৎকার রাষ্ট্র, ক্ষমতা, বিরোধীদল কোনদিন পুরোপুরি বুঝবে? ক্ষমতা এবং ক্ষমতার বাইরের অংশের যে লড়াই সেখানে খেসারত দিতে হয়েছে সাধারণ জনতাকে। কখনো সম্পদ দিয়ে, কখনো জীবন দিয়ে। কী বীভৎসতা, কী পৈশাচিকতা! কাঠের মত চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত মানুষ পুড়ে যাচ্ছে! কেউ কিছু করতে পারছে না। দৃষ্টিসীমার বাইরে পুড়ে গেছে আরও অনেক মানুষ।
লড়াইটা ক্ষমতায় থাকার এবং ক্ষমতায় যাওয়ার। মাধ্যম কতোগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ! লড়াইটা একদফার আর খেসারত এমন একটি গোষ্ঠীর যারা না ক্ষমতার ভেতরের মানুষ, না ক্ষমতার উপকারভোগী। অথচ পুড়তে হচ্ছে। জীবন দিতে হচ্ছে। মাছের বারবিকিউ হওয়ার মত জীবন্ত একটা মানুষ হাজার হাজার চোখের সামনে ছাই হয়ে গেলো। আমরা দেখলাম। ভোটের হিসাব-নিকাশ-করলাম। কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করলো, কেউ সিমপ্যাথির সুযোগ নিল। মানুষের জীবনের মূল্য কেউ দিল কি-না সে প্রশ্নের উত্তর জনগণের কাছে।
স্ত্রী-সন্তানদের ছাড়া যে মানুষ বাঁচার সুযোগ পেয়েও বাঁচতে চায়নি সে মানুষটি রাষ্ট্রের জন্য কতোটা বিশ্বস্ত ছিল সেটা হয়তো রাষ্ট্র কেনদিনই উপলব্ধি করতে চাইবে না। পারবেও না। ভোট উৎসব এবং ভোট বর্জনের মহড়ায় কয়েকটি জীবন, লেলিহান আগুন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের নিমিষেই ছাই হয়ে যাওয়া চাপা পড়ে যাবে। দুঃসহ যানজটের কারনে নাশকতার আড়াই কিলোমিটার দূরের ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লেগে যাওয়ার যে ভৌতিক সমস্যা তা সমাধানের কোন উদ্যোগ থাকবে না! সবাই যার যার মত আখের কুড়াবে।
মানুষ কেমনে পারে? মানুষের দুনিয়ায় মানুষের মত অমানুষ আর নাই! মানুষ পোড়ানোর কাজ যারা করে এরাও মানুষ? কী হবে এই গণতন্ত্র দিয়ে? যা মানুষ পোড়ায় কিংবা মানুষ পোড়ানো বন্ধ করতে পারে না! কী হবে সেই ক্ষমতা দিয়ে? যার কুরসিতে মানুষের রক্তমাখা কিংবা যার যাত্রাপথে অগণিত মানুষের জীবন! মানুষের জন্য যে রাজনীতি সেখানে তো আগুনখেলা থাকার কথা ছিল না জনগণের চোখের ভাষা কেউ কোনদিন পড়তে চায়নি। কেউ জনতাকে জোর করে ভালোবাসতে চেয়েছে আবার কেউ ক্ষমতায় যেতে জনগণকে গুঁটি বানিয়েছে! এই যে ক্ষমতা ক্ষমতা খেলা সেটার পালাবদল সবাই একই পথে, একই ধারায় হাঁটতে চেয়েছে।
কে মরলো, কে পুড়লো, কে সর্বস্ব হারালো-সেই বিচার কেউ কোনদিন করেনি। না ক্ষমতা, না ক্ষমতার বাইরের অংশ। সবসময় নির্মমতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। ক্ষমতাধরেরা এবং ক্ষমতালোভীরা করেছে ভোটের হিসাব। পুড়তে থাকা মানুষের গন্ধের বার্তা কেউ কোনদিন আমলে নেয়নি। সাধারণ মানুষ যে কেবল আগুনে পোড়ে না বরং আরও বহুভাবে পুড়তে পারে সেই বিবেচনা একটা শ্রেণির কখনোই ছিল না। নির্বাচন, ক্ষমতা, বিরোধী শিবির-এই পালাবদলে সবদলগুলোই কাছাকাছি চরিত্র জাহির করেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে সরকার হটানোর সুযোগ খুঁজেছে। অথচ রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং সরকারি সম্পদ যে আলাদা আলাদা বিষয় সেই বোধটুকুও তাদের মধ্যে উধাও ছিল। সরকার এবং রাস্ট্রকে একাকার করে একদল সব ধ্বংস করে দিতে চায়।
চোখের সামনে পুড়তে থাকা একজন মানুষের মৃত্যু নতুন করে আমাদের ভাবাচ্ছে। আমরা সীমাহীন কষ্ট পাচ্ছি। অথচ চোখের অন্তরালেও যাদের মৃত্যু হয়েছে এবং হচ্ছে, মতাদর্শের ভেতরের কিংবা বাহিরের যাদের প্রাণ গেছে এবং যাচ্ছে তার প্রত্যেকটা মৃত্যুই এমন ভয়ংকর এবং বিভৎস। পৃথিবীর কোন মরণ সুন্দর না। কারো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু মানেই মানজীবনের পরিসমাপ্তি, একটি পরিবারের ভোগান্তি। সন্তানদের এতিম হওয়া। ক্ষমতায় থাকুন কিংবা বাইরের থাকুন-কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে ভুক্তভোগীর জায়গায় কল্পনা করুণ! মানুষ মানুষকে কেমনে হত্যা করে? তাও এমন ভেইক মতাদর্শের জন্য, কয়েকটা টাকার জন্য, সাময়িক ক্ষমতার জন্য! মানুষের মত নৃশংস আর কোন হয়েনাও নাই!
ক্ষমতার পাল্টাপাল্টি জনতার জীবনকে সবচেয়ে সস্তা বানিয়েছে। নয়তো একই দেশের সীমানায়, এক শহরের, এক সমাজের এক মানুষ আরেক মানুষকে কেমনে হত্যা করে? যে ক্ষমতা লোভী বানায় সে ক্ষমতার অন্দরমহলে খারাপ উদ্দেশ্য আছে। মন্দের চর্চা নিশ্চয়ই হয়। দমন-পীড়নের যে কালচার তৈরি হয়েছে সেটা থেকে উত্তরণের চেষ্টা দৃশ্যমান না হলে আমরা যে সভ্য সমাজের অংশ সে দাবি কিভাবে করি? আমাদের জন্য ‘আবার তোরা মানুষ হ’ বয়ানটি চরমভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। নয়তো মানুষ পোড়ানো যায় না। মানুষকে হত্যা করতে পারি না। মানুষ হত্যাকে জায়েজ করা বৈধতা দেওয়াও যায় না।
যে পুরুষ স্ত্রী-সন্তানদের ভালোবাসায় সুযোগ থাকা সত্বেও নিজের জীবন বাঁচায়নি সেটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে আত্মহত্যা বলতে নারাজ। পুরুষ আসলে ভালোবাসতে জানে। যারা আপন মানুষদের জন্য জীবন দিতে পারবে তেমন মানুষ আমাদের নেতা হোক, আমাদের মাথার ছায়া হোক। কলাম লেখক, [email protected]