রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:৩৯ am
আন্তর্জাতিক ডেস্ক :
হেনরি কিসিঞ্জার। জার্মান বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। অভিবাসী হয়ে এসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। হয়ে উঠেছিলেন সে দেশেরই জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী। নাগরিক হওয়ার পর থেকেই দেশটির প্রতি তার অনুরাগ ও আনুগত্য বাড়তেই থাকে।
সেখান থেকেই জন্ম নেয় অপকর্মের। কয়েক দশকের ক্যারিয়ারে যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে চালিয়েছেন হত্যাযজ্ঞ। মিত্রদের সাথে হাত মিলিয়ে ভয়ংকর যুদ্ধাপরাধের মতো জঘন্য কাজও করেছেন সমানতালে। তার কূটনৈতিক বুদ্ধিতে বিভিন্ন দেশে ঘটেছে গৃহযুদ্ধও। অভিবাসী থেকে হয়ে উঠেছেন যুদ্ধাপরাধী। বারবার আলোচিত, সমালোচিত হওয়া শতবর্ষী এই নেতা বুধবার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
কিসিঞ্জার ১৯২৩ সালে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে নাৎসি নিপীড়ন থেকে বাঁচতে জার্মানি থেকে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। পরে ১৯৪৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব লাভ করেন। সেখানে হিসাববিজ্ঞান অধ্যয়নের পরিকল্পনা করলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ভাষা দক্ষতা আর সামরিক বুদ্ধিমত্তায় ছিলেন এগিয়ে। পরে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সেও কাজ করেছেন। কিসিঞ্জার ১৯৬৮ সালে তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত হন। এটিই তাকে দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলার সুযোগ করে দেয়। প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সময়ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এখান থেকেই তার বীভৎস রূপ ফুটে উঠেছিল। এ পদ তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দীর্ঘ ও বিস্তৃত স্নায়ুযুদ্ধ পরিচালনা করার সুযোগ দেয়। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করতে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটালেও খারাপ প্রভাব পড়ে যায় কম্বোডিয়ার উপরে। ১৯৬৯ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে কিসিঞ্জার তার সবচেয়ে ভয়ংকর অধ্যায়গুলোর সূচনা করেন। যেটা ছিল কম্বোডিয়ায় গোপন বোমা হামলা চালানো।
কম্বোডিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যুদ্ধ হওয়ার কথা না থাকলেও চার বছর ধরে (১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত) দেশটিতে গোপন বোমা হামলা চালানো হয়। বিভিন্ন অনুমান অনুসারে, এ হামলার অভিযানে শেষ পর্যন্ত এক লাখ ৫০ হাজার থেকে দেড় মিলিয়ন কম্বোডিয়ান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।
১৯৭১ সালে, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির দায়িত্বে থাকাকালীন সময় কিসিঞ্জার বাঙালি জনগণের ওপর নৃশংস দমনপীড়ন চালানোর জন্য পাকিস্তানের কাছে অবৈধ অস্ত্র বিক্রিরও নির্দেশ দিয়েছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খলনায়ক। এ ছাড়াও ১৯৭৩ সালে চিলিতে সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন করেছিলেন। যার ফলে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সমাজতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল। ১৯৭৫ সালে পূর্ব তিমুরে ইন্দোনেশিয়ার আগ্রাসনেও সমর্থন দিয়েছিলেন একইভাবে। ফোর্ড প্রশাসনের সময় তার নীতিগুলো আফ্রিকা বিশেষ করে অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধকেও উসকে দিয়েছিল। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায়, কিসিঞ্জার হত্যাকারী শাসনব্যবস্থাকে সমর্থন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, সংঘাত চালাতে যে ইন্ধন যুগিয়েছেন তা লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এছাড়া অসংখ্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও ঘটিয়েছেন অহরহ। অথচ কিসিঞ্জার সেইসব অপকর্মের জন্য কখনো অনুশোচনা করেননি। এর বিনিময়ে কখনো মূল্যও চোকাতে হয়নি তাকে। উলটো মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক, প্রেস এবং সামাজিক অভিজাতদের সদস্য হিসেবে ভালো অবস্থানে ছিলেন।
কিসিঞ্জার উত্তর ভিয়েতনামের লে ডুক থোর (ভিয়েতনামের বিপ্লবী নেতা) সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য তাকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল। এ সময়ও পড়েছিলেন নানা বিতর্কের মুখে। নোবেল শান্তি পুরস্কারে কিসিঞ্জারের নাম ঘোষণার পরপরই নোবেলের ব্যঙ্গাত্মক নাম ছড়িয়ে পড়ল দেশে দেশে- ‘নোবেল ফর দ্য ওয়্যার প্রাইজ’!কিসিঞ্জারের নামের সঙ্গে নিজের নাম ঘোষণায় পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেন বিপ্লবী নেতা লে ডুক থোরও। হাওয়া বুঝে পুরস্কার নিতে যাননি কিসিঞ্জারও। সূত্র : যুগান্তর