শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:২০ pm
ক্লাসরুমের ডায়াসে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন বিলানো মানুষগুলোকে চিরাচরিত চরিত্র থেকে আজ বিরত থাকতে হচ্ছে। আহ্লাদে নয় বাধ্য হয়ে। শিক্ষকরাই যেখানে চরমভাবে অস্তিত্ব সংকটে ভূগছেন সেখানে উন্নত শিরে আরেকটি প্রজন্মকে বড় হওয়ার দীক্ষা দেয়া দুরূহ বটে। দীর্ঘদিনের নানাবিধ প্রবঞ্চনা, শিক্ষা ক্যাডারকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত অশনি সংকেত সর্বোপরি রাষ্ট্র কর্তৃক শিক্ষকদের সম্মানকে হেয় করে রাখার প্রবনতাই শিক্ষকদেরকে কর্মবিরতি পালন করতে বাধ্য করছে। অথচ অধিকার আদায়ের দাবিতে শিক্ষকরা কারো কাছে ধন্যা দেবে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা মোটেই কাম্য ছিল না। আজ উপায়ন্তরহীন হয়ে বিসিএস শিক্ষা পরিবারের ঐকমত্যে যে ক্ষোভের প্রতিফলন হয়েছে, তাতে আজকের কর্মবিরতিই শেষ কর্মবিরতি হচ্ছে না; যদি না রাষ্ট্র উদ্ভূত পরিস্থিতির বার্তা বুঝতে অক্ষমতা দেখায়। আন্দোলনরত শিক্ষকদের মেসেজটি বোধহয় এরকম, হয় এবার মানতে হবে, নয়ত ভাঙতে হবে।
ডাক্তারদের কর্মবিরতির মত শিক্ষকদের কর্মবিরতি রাতারাতি রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করবে না বটে তবে সারা দেশের সকল সরকারি কলেজ, শিক্ষাবোর্ড, মাউশি এবং নায়েমে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ২রা অক্টোবরের কর্মবিরতি প্রকট বৈষম্যের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি হিসেবে বিবেচিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচীর মত শিক্ষকদের কর্মবিরতি জনসাধারণকে ভোগান্তিতে ফেলবে না বটে কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারের সাথে অন্যান্য ক্যাডারের বৈষম্য, যোগ্যতাধারীদের সময়মত পদোন্নতি না দেয়া, প্রধানমন্ত্রীর আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনের নির্দেশ উপেক্ষা করা, অধ্যাপক পদকে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে না নেয়া, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের পদসমূহে পদায়ন থেকে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের বঞ্চিত করাসহ বিভিন্ন দাবীতে সারাদেশের সরকারি কলেজ শিক্ষকদের কর্মবিরতি, গোটা দেশের শিক্ষক সমাজের সেই কর্মসূচীতে সমর্থন জ্ঞাপন নীতিনির্ধারকদের শিক্ষার প্রতি ঔদাসীন্যকে চপেটাঘাত করবে।
শিক্ষকদের চলমান আন্দোলনে অর্থসংক্রান্ত দাবী আদায়ের কোন দফা নাই, যাতে রাষ্ট্র বিব্রত হতে পারে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাবৃন্দ দীর্ঘদিন যাবৎ যেভাবে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভূগছে তা রাষ্ট্রীয় প্রগতির ইতিবাচক দিক নয়। শিক্ষকদের প্রতি অসম্মানের এ অচলায়তন ভেঙ্গে সম্মানের আসনে আসীন করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদেরকে সম্মান দেখানো রাষ্ট্রের যেমন নৈতিক দায়িত্ব তেমিন প্রজন্মের পরে প্রজন্মকে মাথা তুলে দাঁড়াবার ভিত রচনার করার জন্যই শিক্ষকদেরকে তাদের প্রাপ্য অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। সম্ভবত রাষ্ট্র একমত হবে যে, শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে যে কর্মবিরতি হচ্ছে তা রাষ্ট্রকে জিম্মি করা নয় বরং শিক্ষকদের প্রাপ্যের প্রতি ধারাবাহিক অবজ্ঞা, অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে শিক্ষকদের অধিকার প্রদানে কৃপণতা দেখানো, সামাজিকভাবে শিক্ষকদেরকে পদে পদে সম্মানহানী করা হয়েছে। এমনকি শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যরা তাদের বিসিএস ব্যাচমেটদের সামনেও সম্মানের সাথে দাঁড়াতে পারছে না। একই ব্যাচে চাকুরি পেয়ে শিক্ষার একজন সহযোগী অধ্যাপকে থেকে যাচ্ছে দীর্ঘকাল এবং তার ব্যাচমেট উপসচিব কিংবা পুলিশ সুপারের দায়িত্ব পালনের শেষ ধাপে উপনীত হচ্ছে।
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানে স্মার্ট নাগরিক অন্যতম অনুষঙ্গ। স্মার্ট নাগরিক তৈরিতে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকেই স্মার্ট প্লাটফর্মে দাঁড় করাতে হবে। কলেজসমূহে অপ্রতুল পদ, কর্মরত মেধাবী শিক্ষকদেরকে ধরে রাখার পরিবেশ না থাকায় রোজ ক্লাস কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যেখানে তিনটি পদ থাকা উচিত ক্ষেত্র বিশেষ সেখানে পদ আছে একটি। অত্যন্ত আশ্চর্যের যে, সেই একটি পদও ক্ষেত্রেবিশেষ শূন্য। কাজেই এটা অন্তত যৌক্তিক মনে করা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংখ্যক পদ সৃজনের মাধ্যমে শূন্যপদসময় পূরণ করে স্মার্ট বাংলাদেশের পিলারসমূহকে মজবুঁত করতে হবে। যেখানে ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত হয়ে শিক্ষকগণ কর্মবিরতিতে গেছেন সেখানে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় করার দাবী না তুললেই পারি! কিন্তু শিক্ষা যেহেতু মৌলিক অধিকার এবং একটি জাতিকে দাঁড় করানোর জন্য শিক্ষাই মূল হাতিয়ার সেহেতু রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষকতার পেশাকে আকর্ষণীয় করে তোলা। মেরুদন্ড যদি নড়বড়ে হয়, সে জাতি বড় বড় স্বপ্ন বুননের ক্ষমতা থাকবে না। সুতরাং শিক্ষকদের ন্যায্য দাবীসমূহ অনতিবিলম্বে মেনে নেয়া আবশ্যক।
রাষ্ট্র এগিয়ে এসে শিক্ষক প্রতিনিধিদের দাবীসমূহ নিয়ে আলোচনা করলে সেটা অত্যন্ত মঙ্গলজনক হবে। যে শিক্ষক সমাজ সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিলিয়ে কনভিন্স করেন সেই শিক্ষকদের দাবীসমূহ অযৌক্তিক সেটা মনে করলে কর্তৃপক্ষ ভুল করবে। শুধু শিক্ষকদের সম্মান করেই আজ চীন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকরা যদি উন্নত-সম্মৃদ্ধ জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয় তবে বাংলাদেশের উন্নত-সম্মৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন সুদূঢ় পরাহত হবে।
এদেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবকরা মনে করে, শিক্ষকরা সম্মানিত থাকুক। মানসিকভাবে প্রশান্তিতে থাকা শিক্ষকগণই শান্তিকামী জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। রাষ্ট্রও নিশ্চয়ই সচেতনভাবে শিক্ষার প্রগতিতে প্রতিবন্ধকতা দেখাবে না। আমলাতন্ত্রের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হয়ে সবাই মিলে আমাদের বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবো-সেই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হতে হলে যার যার অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই পদযাত্রায় সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে জাতি গড়ার কারিগর শিক্ষকদেরকে। কেননা যারা জাতির ক্ষতসমূহ মেরামত করবেন সেই তারাই যদি গভীর ক্ষতিত পতিত হন তবে সে দৃষ্টান্ত মোটেই সুখকর নয়। শিক্ষক সমাজকে হতাশায় নিমজ্জিত রেখে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব। শিক্ষকদের স্বার্থকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্র যে পথে হাঁটতে চায় সে পথ সুগম হবে না। হয়ত তাদের কায়েমী স্বার্থও পূরণ হবে না বরং তিক্ততা বাড়বে। কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে, পদে পদে অধিকার বঞ্চিত করে শিক্ষকদেরকে আঘাত করা হবে তবে সে পথ কোন পক্ষের জন্যই সুফল আনবে না।
শিক্ষকরা ব্যানার নিয়ে রাস্তায় মিছিল করুক, পথ আটকিয়ে অবস্থান করুক, কলেজের গেটে তালা লাগুক-সেই দৃশ্য যেমন শিক্ষকদের জন্য শোভনীয় নয় তেমনি রাষ্ট্রের জন্যও সেটি স্বস্তিদায়ক হবে না। শিক্ষকতার সৌন্দর্যের কারনেই শিক্ষকগণ চিরকাল পেশীশক্তিহীন। তবে মন ও মননের সৌন্দর্যে, চিত্তের মাধুর্যে শিক্ষকদের সমকক্ষ আর কেউ নাই। কর্তৃপক্ষের অবিলম্বে সুমতি হোক। আশা করছি, কর্তৃপক্ষের শুভবুদ্ধির মাধ্যমে আজকের কর্মবিরতি শেষেই শিক্ষকরা স্থায়ীভাবে শ্রেণীকক্ষে ফিরতে পারবেন। শিক্ষকতা পেশার সাথে ক্লাস থেকে বিরত থাকা, আন্দোলন-সংগ্রাম করা, কারো কাছে নত মস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা-এসব ইতিবাচক ইঙ্গিত বহন করে না। সুতরাং শিক্ষকগণকে শ্রেণিপক্ষে ফেরার আশ্বাস দেয়া হোক। লেখক : রাজু আহমেদ।কলামিষ্ট, [email protected]।