সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৫৯ am
*রাজশাহীসহ ৬৩ জেলায় একই সময়ে জেএমবির বোমা হামলা, নগরীর ৪ থানায় মামলা, ৩১ জনের সাজা*
ডেস্ক রির্পোট :
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছিল। এই হামলার মাধ্যমে নিজেদের সংঘবদ্ধ উপস্থিতির জানান দেয় জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার ১৮ বছর আজ। ওই দিন দেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে বোমা হামলা চালায় তারা। মুন্সীগঞ্জ ছাড়া সব জেলার প্রায় পাঁচশ পয়েন্টে বোমা হামলায় দুজন নিহত ও অন্তত ১০৪ জন আহত হন। পুলিশ সদর দফতর ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, ঘটনার পরপরই সারা দেশে ১৫৯টি মামলা করা হয়। সেদিন রাজশাহী নগরীর ২৫টি স্থানে বোমা হামলা হয়েছিল। বোমার শব্দে কেঁপেছিল নগরী। এ ঘটনায় নগরীর চার থানায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করেছিল। মামলাগুলোতে ৩১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, জেএমবির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল বাগমারা উপজেলায়। ১৯৯৮ সাল থেকে গোপনে কার্যক্রম শুরু করলেও ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জেএমবি সদস্যরা বাগমারা, নওগাঁর আত্রাই-রানীনগর, নাটোরের নলডাঙ্গায় সর্বহারা দমনের নামে প্রকাশ্যে গলা কেটে এবং নির্যাতন করে হত্যা করে ১৩ জন নিরীহ মানুষকে। পাশাপাশি জঙ্গি সংগঠনটির নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই এবং তাদের সহযোগীদের নির্যাতনে পঙ্গুত্ব বরণ করেন কমপক্ষে ২০ জন। সিরিজ বোমা হামলার ঘটনার পর নগরীর চার থানায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করেছিল। ইতোমধ্যে সবগুলো মামলার রায় হয়েছে।
রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বিজয় বসাক বলেন, ‘রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ যে মামলাগুলো করেছিল, সেগুলোর রায় হয়েছে। আসামিরা বিভিন্ন মেয়াদে সাজাও ভোগ করছে। চার মামলায় ৩১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এ ছাড়া পাঁচ জন খালাস পেয়েছে।’
আদালতের বিচার সম্পন্ন হওয়া মামলার এজাহার ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, নগরীতে ওই বোমা হামলায় কেউ হতাহত না হলেও জেলাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই দিন বেলা ১১টা ৫ মিনিটে প্রথম বোমাটি বিস্ফোরিত হয় নগরী সাহেববাজার জিরো পয়েন্টের একটি বিদ্যুতের খুঁটির কাছে। এখানে একটি সাইকেলের ওপর রাখা ব্যাগের মধ্যে দুটি বোমা রাখা হয়েছিল। এরপর আরডিএ মার্কেটের প্রধান গেট, রাজশাহী মহিলা কলেজের সামনে, নিউ মার্কেটের প্রধান ফটক, রেলগেট, রাজশাহী রেলস্টেশন চত্বর, তালাইমারী, কাজলা গেট, কাটাখালি, নওদাপাড়া, রুয়েট গেট, লক্ষ্মীপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে, জেলা জজের গাড়ির নিচে, জেলা প্রশাসকের অফিসের নিচতলায়, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত চত্বরে বোমা বিস্ফোরিত হয়। বাকি স্পটের বোমাগুলি বিস্ফোরিত হয়নি।
এ ঘটনার পর পুলিশ ও র্যাব ওই স্থানগুলো ঘিরে ফেলে এবং আশপাশে তল্লাশি চালায়। পুলিশ বিভিন্ন স্পট থেকে অবিস্ফোরিত ১০টি তাজা বোমা উদ্ধার করে। বোমাগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর পুলিশ কর্মকর্তারা এগুলোকে কম ক্ষমতা সম্পন্ন বলে দাবি করেছিলেন।
বোমা বিস্ফোরণে জেলা ও দায়রা জজের সরকারি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আদালত চত্বরে বিস্ফোরণের পরপরই আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। নগরীর বিভিন্ন মার্কেট ফাঁকা হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় দোকানপাট। পরে নগরীর বোয়ালিয়া, রাজপাড়া, মতিহার ও শাহমখদুম থানায় চারটি মামলা করা হয়।
বোয়ালিয়া থানার মামলা :
সাহেববাজার জিরো পয়েন্ট ও আরডিএ মার্কেট এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বোয়ালিয়া থানার তৎকালীন এসআই সিদ্দিকুর রহমান বাদী হয়ে ওই দিন জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ আট জনের নামে একটি মামলা করেন। ২০০৬ সালের ৩০ মে ১৯ জন জেএমবি সদস্যকে অভিযুক্ত করে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন তিনি। এই মামলায় ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর জেএমবির সাত সদস্যকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। রাজশাহী দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একরামুল হক চৌধুরী এ রায় দেন। রায়ে প্রত্যেকের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাজাপ্রাপ্তরা হলো জেএমবি নেতা শফিউল্লাহ ওরফে তারেক, আবু ইছা ওরফে এনামুল হক আকন্দ, জহুরুল ইসলাম, এনামুল হক ওরফে এনামুল, আমানুল্লাহ ওরফে আবু সাইদ, কোরবান আলী ও তরিকুল ইসলাম।
মতিহার থানার মামলা :
নগরীর কাজলা গেটের পশ্চিম পাশে বোমা হামলার ঘটনায় মতিহার থানার তৎকালীন এসআই খতের আলী বাদী হয়ে ওই দিন জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ ১০ জনের নামে একটি মামলা করেন। এই মামলায় তৎকালীন এসআই চাহেল উদ্দিন ২০০৬ সালের ৬ মার্চ ১০ জনকে অভিযুক্ত করে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন। ২০০৯ সালের ২২ মার্চ বিভাগীয় স্পেশাল ও বিশেষ দায়রা জজ আদালতের বিচারক ১০ জেএমবি সদস্যের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলো এনামুল হক, আরিফ, আবদুর রহমান ওরফে খালিদ, তরিকুল ইসলাম, শফিউল্লাহ, আবু ইছা, সিদ্দিকুল ইসলাম, হাসান, জাহাঙ্গীর ও আবদুল আওয়াল।
শাহমখদুম থানার মামলা :
নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় বোমা হামলার ঘটনায় শাহমখদুম থানার তৎকালীন এসআই আমিরুল ইসলাম বাদী হয়ে হয়ে ওই দিন আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ আট জনের নামে একটি মামলা করেন। এই মামলায় শাহমখদুম থানার তৎকালীন এসআই আমিনুল ইসলাম ২০০৬ সালের ১০ মে সাত জনের বিরুদ্ধে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এর মধ্যে ফাঁসির আদেশ কার্যকর হওয়া জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইকে বাদ দেওয়া হয়। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে একজনকে ২০১২ সালের ১২ নভেম্বর রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক একরামুল হক চৌধুরী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপর চার আসামিকে খালাস দেওয়া হয়।
রাজাপাড়া থানার মামলা :
এ ছাড়া নগরীর রাজপাড়া থানার কালেক্টরেট ভবন এলাকায় বোমা হামলার ঘটনায় ওই থানার তৎতালীন এসআই একেএম মাসুদ রানা বাদী হয়ে ওই দিন জঙ্গি আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইসহ ১০ জনের নামে একটি মামলা করেন। এই মামলায় ২০০৬ সালের ১৫ জুন রাজপাড়া থানার ওসি আকরাম হোসেন ১০ জনের নামে মহানগর মুখ্য হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন। এর মধ্যে জঙ্গি শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাইয়ের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে জেএমবি নেতা শফিউল্লাহ, এনামুল হক, আরিফ, তরিকুল ইসলাম, আবু ইছা, কোরবান, জহুরুল ও আমানুল্লাহর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন