সমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:২৩ am
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহীতে পরিবহণ থেকে বেপরোয় চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদা তুলছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের কয়েকটি গ্রুপ। তাদের সহযোগিতা করছে রাজশাহী জেলা মোটর, ট্রাক, ট্রাংকলরি মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে বাঁশের মাচা পেতে রাজশাহী বাইপাস সড়কে চলাচল করা যানবাহন থেকে দিনরাত চাঁদা তোলা হচ্ছে। আরেকটি দল রাজশাহী-নওগাঁগামী উত্তরমুখী মহাসড়কের আমচত্বর পয়েন্টে চাঁদা উঠাচ্ছে। নগরীর আরও দুটি পয়েন্টে ট্রাকসহ যানবাহন থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরেজমিন দেখা যায়, সোনামসজিদ স্থলবন্দর থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলামুখী মালবাহী শত শত ট্রাক ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ থেকে আসা চাল, আম, সবজি, মাছসহ কাঁচাপণ্য পরিবাহী ছোট ও মাঝারি ট্রাকও রেহাই দিচ্ছে না চাঁদাবাজরা। ভুক্তভোগী ট্রাকচালকরা বলছেন, ছয় মাস আগে নগরীর নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে চকি বসিয়ে চাঁদা তোলা শুরু হয়। প্রথম দিকে চাঁদাবাজদের পাহারায় এখানে পুলিশ ছিল। তাবে কিছুদিন পর পুলিশ সরে যায়। জানা যায়, নওদাপাড়ায় চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দিচ্ছেন নগরীর ১৭নং পূর্ব ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার হোসেন। তিনি নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের ইজারাদার।
সুলতান শেখ, শামীম পাটোয়ারি, কবির হোসেনসহ একাধিক ট্রাকচালক অভিযোগ করেন, চারটি টোকেনের মাধ্যমে রাজশাহী বাইপাস মহাসড়কের নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে পূর্ব ও পশ্চিমমুখী প্রতিটি ট্রাক, ট্যাংকলরি, সেমি-ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক্টর থেকে ১০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হচ্ছে। এই মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন ছয় হাজারের বেশি ট্রাকসহ মালবাহী যানবাহন চলাচল করে। এই হিসাবে এখানে দৈনিক ছয় লক্ষাধিক টাকা চাঁদা উঠছে। একইভাবে আমচত্বরের উত্তরের মাদ্রাসার সামনে বসে নওগাঁ থেকে আসা ও নওগাঁগামী মালবাহী যানবাহন থেকে সমপরিমাণ চাঁদা উঠানো হচ্ছে। আর নওগাঁ থেকে আসা দক্ষিণবঙ্গগামী মালবাহী ট্রাকগুলোকে চাঁদার জন্য আটকানো হচ্ছে নওদাপাড়া বাস টার্মিনালের সামনে।
শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে সরেজমিন দেখা যায়, নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে সড়কের কোলঘেঁষে বাঁশের মাচা পেতে বসে আছেন জনাপাঁচেক লোক। সবার হাতে বাঁশের লাঠি। কারও কারও লাঠির মাথায় লাল কাপড় বাঁধা। পশ্চিম থেকে পূর্বমুখী মালবাহী যানবাহন স্পটে আসামাত্রই লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে সড়কে ব্যারিকেড দিচ্ছেন দুই যুবক। এরপর চারটা সিপ ধরিয়ে আদায় করছেন ১০০ টাকা। চাঁদা তোলা দুই যুবকের কাছে নাম ও তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা না বলে আবার ট্রাকের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বাঁশের মাচায় টাকার ব্যাগ জমা রাখা দুই বয়স্ক ব্যক্তিও নিজেদের নাম বলতে অসম্মতি জানান। তাদের একজন বলেন, টার্মিনালের ইজারাদার আওয়ামী লীগ নেতা সারোয়ার হোসেন। তার সঙ্গে কথা বলেন। স্থানীয় এক দোকানদার জানান, এই চাঁদাবাজির সঙ্গে পুলিশসহ অনেকেই জড়িত। অভিযোগ পেয়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের লোকজন কিছু দিন আগে টার্মিনালের টোলের নামের চাঁদা তোলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু আরডিএর কথা কেউ আমলে নেয়নি। এক মিনিটের জন্য বন্ধ করা হয়নি চাঁদাবাজি।
ভুক্তভোগী ট্রাকচালকরা জানান, চারটি স্লিপের মধ্যে ৩০ টাকা নেওয়া হচ্ছে ট্রাক টার্মিনালের ইজারার টোল হিসাবে। বাকি ৭০ টাকা নেওয়া হচ্ছে ট্রাক মালিক, শ্রমিক, মোটর মালিক ও শ্রমিক এবং মোটর শ্রমিক হাসপাতালের নামে। প্রতি মাসে নগরীর এই একটি স্পট থেকেই এক থেকে দেড় কোটি টাকা চাঁদা উঠছে।
জানা যায়, নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালটি তিন বছরের জন্য মাত্র ১৪ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছেন ১৭নং পূর্ব ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সারোয়ার হোসেন। ইজারাদাতা আরডিএ থেকে ইজারার শর্তে উল্লেখ করেছেন, টার্মিনালের বাইরে অথবা সড়কে টার্মিনালের নামে কোনো চাঁদা তোলা যাবে না। এমনটা ঘটলে ইজারা বাতিল করা হবে। কিন্তু তিনি শর্ত মানছেন না।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান বলেন, ট্রাক টার্মিনালের নামে সড়ক বা মহাসড়কে যানবাহন আটকে চাঁদা নেওয়া যাবে না-এটা আমরা ইজারার শর্তে বলে দিয়েছি। এই শর্ত ভাঙলে ইজারাদারকে নোটিশ করা হবে। ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা ট্রাক, ট্যাংকলরি, কাভার্ডভ্যান ও ট্রাক্টর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে যানবাহন আটকে চাঁদা তোলার নিয়ম নেই। কিন্তু সংগঠন চালানোর জন্য তুলতে হচ্ছে। নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের নামে যেহেতু চাঁদা তোলা হচ্ছে, তাই আমরাও তুলছি। আমাদের তোলা টাকা শ্রমিকদের উন্নয়নে ব্যয় হয়। নুরু আরও জানান, পুলিশ কর্মকর্তা ও নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাক থেকে টাকা তোলার সিদ্ধান্ত হয়।’ রাজশাহী জেলা ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুকুল হোসেন বলেন, ‘অন্যারা টাকা তুলছে, তাই আমরাও তুলছি। সমিতি চালাতে তো খরচ হয়।’
নওদাপাড়া ট্রাক টার্মিনালের নামে চাঁদাবাজির বিষয়ে নগরীর ১৭ নম্বর পূর্ব ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও টার্মিনালের ইজারাদার সারোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইজারার টাকা তুলতে হবে। তাই টার্মিনালের সামনে দিয়ে যাওয়া ট্রাক থেকে টোল নেওয়া হচ্ছে। এটাকে চাঁদা বলা ঠিক হবে না। এটাকে টোল বলাই ভালো।’ ইজারার শর্তাবলিতে সড়কে যানবাহন আটকে টোল তোলা যাবে না বলে উল্লেখ আছে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে সারোয়ার হোসেন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন।
রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাতাব হোসেন বলেন, চাঁদার ১০০ টাকার মধ্যে মাত্র ১০ টাকা আমরা নেই। বাকি টাকা মোটর শ্রমিক হাসপাতালে শ্রমিকদের চিকিৎসা খাতে ব্যয় হয়। মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের বন্ধ হাসপাতালে কোন শ্রমিকের চিকিৎসা হয়? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি মাহাতাব হোসেন। জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রফিকুল আলম বলেন, কোথায় কীভাবে কারা ট্রাক থেকে চাঁদা তুলছে সে বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করব। রা/অ