সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০১:৪৭ pm
ডেস্ক রির্পোট :
অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্বপ্নের প্রকল্প ‘সবার জন্য পেনশন’। সব কিছুই প্রস্তুত, ‘কর্তৃপক্ষ’ গঠন এখন শুধু সময়ের ব্যাপারমাত্র। আগামী জুলাই থেকে ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা’ স্কিমের পাইলটিং শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আসন্ন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এ বিষয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনার কথা জানাবেন। শুরুতে মডেল জেলা হিসেবে ঢাকা এবং অন্য যেকোনও একটি জেলায় এই পাইলটিং কার্যক্রম শুরু হবে। পরে পর্যায়ক্রমে বাকি জেলাগুলোতে এর কার্যক্রম শুরু হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের প্রায় ৬ কোটি মানুষ কর্মক্ষম। তাদের সবার জন্য পেনশন ব্যবস্থা চালু করা একটা বিরাট কাজ। তাই এটি শুরু করার আগে প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামো গড়ে তোলা, বিদেশি পরামর্শদাতা নিয়োগসহ অনেক প্রস্তুতি নেওয়ার পর এখন আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে সরকারের ‘সবার জন্য পেনশন স্কিম’। সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় আপাতত সরকারি চাকরিজীবীদের বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে বেসরকারিভাবে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ। তাদেরকে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত রয়েছেন দেশের ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ মানুষ। এ তালিকায় রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, কৃষকসহ বিভিন্ন পেশায় জড়িতরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন।
জানা গেছে, ‘সবার জন্য পেনশন’ আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদের পরিকল্পনা। আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থমন্ত্রী থাকাকালে ২০১৭-১৮ সালের প্রস্তাবিত বাজেটে তিনি এ স্কিম সম্পর্কে একটি রূপরেখা দিয়েছিলেন। এ জন্য পাইলট প্রকল্পের কথাও বলেছিলেন তিনি। সর্বজনীন পেনশনকে আবুল মাল আবদুল মুহিত তার স্বপ্নের প্রকল্প বলেও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এটি চূড়ান্ত করে দিয়ে যেতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার দল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেও তিনি সরকারের কোনও মন্ত্রীত্ব পাননি। তাই পরিকল্পনাটি ঝুলে যায়। পরে অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া আ হ ম মুস্তফা কামাল এ প্রকল্পটিকে ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে হলেও এগোতে থাকে এর কার্যক্রম। আশা করা যাচ্ছে, নতুন অর্থবছরের বাজেটে এ প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখবে।
অর্থ মন্ত্রণালয সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ গঠনের দাফতরিক আদেশ জারি করা হয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে নতুন নির্মিত অর্থভবনের কোনও একটি ফ্লোরে তাদের দাফতরিক কার্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়েছে। অপরদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব গ্রহণের আগেই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার অগ্রবর্তীমূলক কাজকর্ম গুছিয়ে রেখেছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। অর্থাৎ, এ সম্পর্কিত আইন প্রণয়ন, তদানুযায়ী তার বিধিমালা ও নীতিমালার খসড়া কৌশলপত্র তৈরির কাজও শেষ। কর্তৃপক্ষ নিয়োগ সম্পন্ন হওয়ার পর পরই যেন তারা ত্বরিত গতিতে পাইলটিংয়ের কাজ শুরু করতে পারে।
জানা গেছে, ৬ ধরনের প্রোডাক্ট স্কিম নিয়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। প্রকল্পের প্রতিটি প্রোডাক্ট স্কিম হবে স্বতন্ত্র। সব প্রোডাক্টেই একটি ন্যূনতম চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। কেউ চাইলে বেশিও জমা করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত তহবিলে সংশ্লিষ্ট প্রোডাক্ট স্কিমের হিসাবে যার যত বেশি প্রিমিয়াম জমা পড়বে, তার আর্থিক সুবিধা পাওয়ার হারও তত বেশি হবে।
জানা গেছে, পেনশন তহবিলে নাগরিকদের চাঁদা হিসেবে জমা দেওয়া তহবিল— সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগের পাশাপাশি সরকারের লাভজনক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হবে। এতে সরকারের ব্যাংক ঋণ-নির্ভরতা কমবে। বিনিয়োগ থেকে পাওয়া মুনাফার পাশাপাশি তহবিলে সরকারের কন্ট্রিবিউশনও থাকবে। যদিও সরকারের অবদান কত শতাংশ হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি। এই পেনশন ব্যবস্থা চালুর পর বয়স্কভাতাসহ বর্তমানে বিদ্যমান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর বেশ কিছু কর্মসূচি সংকুচিত করে পেনশন তহবিলে অর্থ ব্যয় করা হবে। দেশজুড়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পুরোদমে চালু হওয়ার পর থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্তদেরও এই পেনশন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গভাবে দেশজুড়ে বাস্তবায়ন হবে বলে আশা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বর্তমানে সরকারি চাকরিরতদের পাশাপাশি তার (২০২৫) আগ পর্যন্ত যারা সরকারি চাকরিতে যোগদান করবেন, তারা এখনকার মতোই সরকার থেকে পেনশন পাবেন।
অর্থ মন্ত্রণালয সূত্র জানিয়েছে, দেশের ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী প্রায় ১০ কোটি নাগরিককে ক্যাটাগরি অনুযায়ী ভাগ করে— এই স্কিম নির্ধারণ করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে:১. বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক চাকরিজীবী পেনশনার স্কিম, ২. প্রবাসী বা অনিবাসী পেনশনার স্কিম, ৩. শ্রমিক শ্রেণি স্কিম, ৪. অপ্রাতিষ্ঠানিক জনগোষ্ঠী স্কিম, ৫. সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি ফান্ডেড স্কিম এবং, ৬. শিক্ষার্থী স্কিম। আগামী জুলাইয়ের শেষে এসব স্কিমের আওতায় আগ্রহী পেনশনারদের নিয়ে পাইলটিংয়ে যাওয়ার পরিকল্পনাও প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে।
গঠিত সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের নিয়োগপ্রাপ্ত অফিসিয়ালরাই জানাবেন কে কোন ক্যাটাগরির প্রোডাক্ট স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন। এক্ষেত্রে আগ্রহী পেনশনারের বয়স, কর্মক্ষেত্র, আয় এবং সামাজিক মর্যাদা তথা নির্ধারিত হারে চাঁদা দেওয়ার সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাব্য প্রোডাক্ট স্কিম ঠিক করা হবে। আইন অনুযায়ী, এ ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর একজন নিবন্ধিত পেনশনারকে অন্তত ১০ বছর কিস্তি চালিয়ে যেতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের প্রতিটি প্রোডাক্ট স্কিম হবে স্বতন্ত্র। সব প্রোডাক্টেই একটি ন্যূনতম চাঁদার হার নির্ধারিত থাকবে। কেউ চাইলে বেশিও জমা করতে পারবেন। কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত তহবিলে সংশ্লিষ্ট প্রোডাক্ট স্কিমের হিসাবে যার যত বেশি চাঁদা জমা পড়বে, তার আর্থিক সুবিধা পাওয়ার হারও তত বেশি হবে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ জনশুমারি ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হালনাগাদ ভোটার তালিকা সমন্বয় করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী দেশে নিবাসী-অনিবাসী মিলে এমন নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১০ কোটি। যারা এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে পারেন। তবে সবার জন্য বাধ্যতামূলক না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে এই জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কেবল আগ্রহীদেরই এই ৬ ধরনের প্রোডাক্ট স্কিমের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সূত্রমতে, যে ক’টি প্রোডাক্ট স্কিম চালু করা হবে, তার মধ্য থেকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিভুক্ত জনগোষ্ঠীর জন্য নির্ধারিত সরকারি ফান্ডেড স্কিমে অন্তর্ভুক্তদেরই কেবল নির্ধারিতহারের চাঁদার একটা অংশ সরকার বহন করবে। বর্তমানে দেশে ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী জনসংখ্যা রয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর ১৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ বা ৩ কোটি ২০ লাখ। জনসংখ্যার এই শ্রেণিকে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আওতায় ‘শিক্ষার্থী মডেল’ হিসেবে ধরা হবে।
কোন বছর থেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশকারীদের ক্ষেত্রে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা কার্যকর হবে, তা সরকার নির্ধারণ করে দেবে। ১০ বছরে সরকারি চাকরিজীবীদের মাসিক সর্বোচ্চ গ্রস পেনশনের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে, তার ওপর প্রতিবছর ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যুক্ত হচ্ছে। পেনশনার ও পারিবারিক পেনশনারের মৃত্যুর পর তাদের নাবালক সন্তান এবং অবিবাহিত মেয়ে ও প্রতিবন্ধী সন্তান আজীবন পেনশন সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি খাতে কর্মরতদের জন্য অবসর জীবনে ও তাদের সন্তানদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোনও সুবিধা নেই। সর্বশেষ লেবার ফোর্স জরিপ অনুসারে, বর্তমানে বেসরকারি খাতে কর্মচারীর সংখ্যা ৫ কোটি ৮৫ লাখ, আর সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনবলের সংখ্যা ২২ লাখ ৮৯ হাজার।
উল্লেখ্য, বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের একাংশ কন্ট্রিবিউটরি প্রভিডেন্ট ফান্ড (সিপিএফ) ও গ্র্যাচুইটি সুবিধা পেলেও অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা অবসরকালে কোনও সুবিধাই পান না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এটি নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এটি এক ধরনের সুরক্ষা। অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা চাকরি জীবন শেষে কর্মকর্তা বা কর্মচারিকে খালি হাতে বাড়ি পাঠায়। তখন তারা চেখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। সরকারের এই উদ্যোগটি তাদের জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ বলেও জানান তিনি।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পরিকল্পনাটি সরকারের নিজস্ব। অনেকদিন ধরেই চলছে এর কাজ। এখন প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। বাজেটে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটবে।’ সূত্র : বাংলাট্রিবিউন