শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:০৬ am
হয়তো একেই বলে তুঘলকি কারবার। একদিকে টানা উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার লাগামছাড়া ব্যয় আর অন্যদিকে আয় না বাড়ার বাস্তবতা—দুই দিকের চাপে চিড়েচ্যাপটা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবন। আর এই নাজুক সময়টাতেই পানি, গ্যাস, বিদ্যুতের পরিষেবা দেওয়া সরকারের সংস্থাগুলো যেন দাম বাড়ানোর রিলে রেসে নেমেছে।
এবার ট্র্যাকে রাজধানী ঢাকার আশপাশের জেলায় পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) একবারে দুই চুলার জন্য ৫১২ টাকা আর এক চুলার জন্য ৩৯০ টাকা মাসিক বিল বাড়ানোর প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
প্রথম আলোর খবর জানাচ্ছে, তিতাসের এই প্রস্তাবে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে চেয়েছে বিইআরসি। এতে যে খুব লাভ হতে পারে, তেমনটা আশাবাদী হওয়ার কারণ দেখি না। কারণ, এখানেও দুটি কথা আছে। এক. ডলার-সংকটে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিতে জ্বালানিতে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার শর্ত রয়েছে। দুই. গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের দাম সমন্বয়ের (আদতে বাড়ানো) ক্ষমতাও সরকারের হাতে। ফলে তিতাসের অযৌক্তিক আবদারের জোয়াল যে আরও শক্ত করে ভোক্তার ঘাড়ে এসে চাপছে, তা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আবাসিক গ্রাহকদের গ্যাসের দাম শেষবার বাড়ে গত বছরের জুনে। সে সময় গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিইআরসি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছিল, সাধারণ পরিবারগুলো রান্নার জন্য গড়ে যে পরিমাণ গ্যাস ব্যবহার করে, তার চেয়ে বেশি ধরেই তারা গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোর খবরটা এক নজর দেখে নেওয়া যাক: ‘এ সময় প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৮ টাকা করা হয়। তবে মিটার ছাড়া গ্রাহকদের জন্য মাসে গ্যাস ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে দুই চুলায় ৬০ ঘনমিটার ও এক চুলায় ৫৫ ঘনমিটার ধরা হয়। এতে দুই চুলার মাসিক বিল ১ হাজার ৮০ ও এক চুলার বিল ৯৯০ টাকা ঘোষণা করা হয়। সে ঘোষণার ১০ মাস পর এখন আপত্তি জানাচ্ছে তিতাস।
বিইআরসির কাছে সম্প্রতি একটি চিঠি দিয়েছে তিতাস। এতে বলা হয়, কমবেশি ২৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই ঘনমিটারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
তবে বিইআরসি সূত্র বলছে, তিতাসের অভিযোগ সঠিক নয়। গত বছর গ্যাসের দাম নিয়ে শুনানির সময় তিতাসের ৩ লাখ ২০ হাজার ও চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির ৫০ হাজার প্রিপেইড মিটার গ্রাহকের গ্যাসের বিল বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে। এতে দেখা যায়, দুই চুলার গ্রাহকেরা গড়ে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন মাসে। কিন্তু এটি কিছুটা বাড়িয়ে ৬০ ঘনমিটার নির্ধারণ করা হয়েছিল মিটার ছাড়া গ্রাহকদের জন্য। একই সময় বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে ঘনমিটারের পরিমাণ আরও কমানো হবে।’
প্রশ্ন হলো, যে যতটুকু গ্যাস পোড়াবে, সে ততটুকুই কেন বিল দেবে না? যে পরিবার মাসে ২০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবে আর যে পরিবার মাসে ২০০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবে, তাদের মাসিক বিল সমান হবে কোন যুক্তিতে? এই অসম ব্যবস্থার সুযোগটাই নিচ্ছে তিতাস।
তিতাসের দাবি হচ্ছে, দুই চুলা ব্যবহারকারীরা মাসে গড়ে ৯৭ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করে। তাদের যুক্তি হলো, শিল্প এলাকায় বাসায় সাবলেট বসিয়ে, কিংবা পানি ফোটানোর জন্য চুলা জ্বালিয়ে রেখে গ্যাস পোড়ানো হচ্ছে। পোস্টেজ মিটার ব্যবহারকারী প্রায় ৫৪ হাজার গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহারের হিসাব তুলে ধরে দাম বাড়ানোর এই আবদার করেছে তিতাস। অথচ প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী ৩ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহারের হিসাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ২৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৩ লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের গ্যাস ব্যবহারের তথ্য কী যথেষ্ট নয়, গড়ে একটা পরিবার মাসে কতটা গ্যাস ব্যবহার করে। তাহলে তিতাসের এই আজগুবি আবদারের পেছনে কারণ কী?
এর কারণ একটাই। দেদার অবৈধ সংযোগ দিয়ে তিতাসের একশ্রেণির কর্মচারী-কর্মকর্তারা দিনেদুপুরে গ্যাস চুরি করছেন, তার দায়টা আবাসিকের গ্রাহকদের ওপর তারা চাপিয়ে দিতে চায়। গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের ক্ষেত্রে প্রায় ৫ শতাংশ সিস্টেম লস বা কারিগরি ক্ষতি হয়। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে সিস্টেম লস বা কারিগরি ক্ষতির কোনো সুযোগ নেই। শিল্প, আবাসিক সব জায়গাতেই এই অবৈধ সংযোগ রয়েছে। তাতে তিতাসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজদের পকেট ভরছে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ইজাজ হোসেন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সিস্টেম লসের নামের যে পরিমাণ গ্যাস চুরি হয়, তা দিয়ে বাড়তি ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত। অথচ ডলার-সংকটের এ সময় বলা চলে সোনার দামেই বিদেশ থেকে এলএনজি কিনে আনতে হচ্ছে।
তিতাসের একশ্রেণির দুর্নীতিবাজেরা একদিকে চুরি করবেন, অন্যদিকে সে চুরির ঘাটতি শুভংকরের ফাঁকির অঙ্ক সাধারণ ভোক্তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চাইবে। অথচ এই চুরি, দুর্নীতি ব্যর্থতার জন্য কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না? তিতাস-ওয়াসার মতো সেবা সংস্থাগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ডকে এভাবে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়ার অর্থ কী?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, তিতাসের চুরি আর ব্যর্থতার দায় কেন সাধারণ ভোক্তা নেবেন? গ্যাসের দামের বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা এমনিতেই বৈষম্যমূলক। আমার পরিচিত অনেক পরিবার আছে, যাদের সপ্তাহে এক দিনের বেশি চুলা জ্বালানোর সুযোগ কম। স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করায় সপ্তাহের ছয় দিনই তাঁদের বাইরে খেতে হয়। এ রকম পরিবারকেও কেন বাধ্যতামূলকভাবে গ্যাসের বিল দিতে হবে?
প্রশ্ন হলো, যে যতটুকু গ্যাস পোড়াবে, সে ততটুকুই কেন বিল দেবে না? যে পরিবার মাসে ২০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবে আর যে পরিবার মাসে ২০০ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করবে, তাদের মাসিক বিল সমান হবে কোন যুক্তিতে? এই অসম ব্যবস্থার সুযোগটাই নিচ্ছে তিতাস।
কম খেয়ে, কম পড়ে, এর কাছে ওর কাছে ধার করে কিংবা নানাভাবে কাঁটছাট করে বেশির ভাগ মানুষ যখন উটপাখির মতো ঘাড় গুজে চলমান খারাপ সময়টা পার করে দিতে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে, সে সময় তিতাসের এই অযৌক্তিক আবদার তাদের কাছে রীতিমতো শাস্তি। চুরি, দুর্নীতি বন্ধ না করে গ্যাসের চুলার বিল বাড়িয়ে শাস্তিটা কাকে দিতে চায় তিতাস? লেখক : মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। সূত্র : প্রথম আলো