বৃহস্পতিবর, ২১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:১৭ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক :
রাজশাহী মহানগরীর স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে পদ্মা নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারিকৃত এলাকার নদীর মধ্য দিয়ে ফের রাস্তা নির্মাণ করার অভিযোগ উঠেছে। গভীর রাতে বেশিসংখ্যক শ্রমিকদের দিয়ে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) ১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রজব আলী মহানগরীর তালাইমারী এলাকার পদ্মার বুকে এই রাস্তা নির্মাণ করছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রের দাবি, সর্বশেষ মঙ্গলবার (৫ জানুয়ারি) গভীর রাত থেকে বুধবার (৬ জানুয়ারি) সুর্যদয় পর্যন্ত তিনি এই রাস্তা নির্মাণের কাজ করিয়েছেন।
এর আগে গত রোববার ও সোমবার গভীর রাতে রাস্তা নির্মাণের খবর পেয়ে মঙ্গলবার বিকেলে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাহামুদুল হাসানের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। কিন্তু সে সময় রজব আলী বা তার লোকজনকে যাওয়া যায়নি। তবে রাস্তা নির্মাণ কার্যক্রমের প্রমাণ পেয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয়দের ভ্যাষ্য, ঘটনাস্থলে পৌছার পূর্বেই অভিযান পরিচালনার খবর জেনে যাওয়ায় তারা ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত পালিয়ে গেছে। এরপর পুনরায় গভীর রাতে রাস্তা নির্মাণের কাজ করা হয়েছে। ফলে যথা সময়ে সংশ্লিষ্ট টিম উপস্থিত হলে তাদেরকে হাতে নাতে ধরা যাবে বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
রাজশাহী জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর তালাইমারির এই এলাকা দিয়ে বালু উত্তোলন ও পরিবহনের উপর উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়াও জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার সিদ্ধান্তক্রমে বালু উত্তোলনে তালাইমারি এলাকা ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন জেলা প্রশাসন।
জানা গেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রজব আলী এই বছর রাজশাহীর ‘দিয়াড়খিদিরপুর’ ও ‘চরশ্যামপুর’ বালুমহাল ইজারা নিয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসনের শর্ত অনুযায়ী তিনি বালু উত্তোলন, মজুদ ও পরিবহনের জন্য শুধুমাত্র চরশ্যামপুর এলাকা ব্যবহার করতে পারবেন। কিন্তু তিনি জেলা প্রশাসনের সেই আদেশ অমান্য করে বালু উত্তোলন করছেন ইজারাকৃত বালুমহালের ৬/৭ কিলোমিটার দূরে তালাইমারি এলাকায়। সেখানে দুটি ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু তোলে মজুদ করা হচ্ছে। আর সেই বালু পরিবহনের জন্য পদ্মার বুকে অবৈধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে এ রাস্তা। এর আগে গত নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকে সেখানে ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন ও পদ্মার বুকে রাস্তা নির্মাণকাজের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হলে তা সরিয়ে নেয়া হয়েছিল।
বুধবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারী ঘাট থেকে একটু দূরে পদ্মা নদীর চর জেগেছে। ওই চরের পর (দক্ষিণে) নদীর মূল ধারা প্রবাহিত। কিন্তু ওই চরে ড্রেজিং করে বালু মজুদ করা হচ্ছে। সেখান থেকে সরাসরি ট্রাকে করে বালু আনতেই নদী ভরাট করে রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। আর এই রাস্তা তৈরি করতে মঙ্গলবার গভীর রাতে নদীর বাঁম তীর থেকে ইট ও কংক্রিটের বর্জ্য ফেলার প্রমাণ দেখা গেছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী পরিবেশ আন্দোলন ঐক্য পরিষদের উপদেষ্টা ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, গত বছর একইভাবে নদী ভরাট করে রাস্তা করা হয়েছিল। ওই সময় পরিবেশবাদীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় এক ব্যক্তির করা রিটে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন পদ্মার বুকে রাস্তা নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিল। একই সঙ্গে ইজারাদারকে রাস্তা অপসারণ করে নিতে বাধ্য করে। এখন পর্যন্ত হাইকোর্টের সেই আদেশ বলাবদ রয়েছে। কিন্তু সেই আদেশ অমান্য করে আবারো পদ্মার বুকে ইট ও কংক্রিটের বর্জ্য ফেলে রাস্তা তৈরী করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, পদ্মার বুকে ইট ও কংক্রিটের বর্জ্য ফেলে রাস্তা তৈরীর ফলে শহরের তীর ঘেঁষে যে জলাধার আছে সেটি থাকবে না। পুরোটাই চর পড়ে যাবে। এতে শহরের পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়াও বিনোদনের জন্য লোকজন আর পদ্মা পাড়ে যেতে পারবে না। ধুলা-বালিতে ওই এলাকার পরিবেশ বসবাসের অনুপযোগি হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপআ) রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি ও রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান বুধবার (৬ জানুয়ারি) রাত পৌনে আটটার দিকে মুঠোফোনের মাধ্যমে জানান, ‘পদ্মার বাঁধ ও নদীর পানির স্বাভাবিক গতি বজায় রাখার লক্ষ্যে অবিলম্বে বালু উত্তোলনসহ পদ্মার মধ্যে রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধের জন্য জেলা প্রশাসনের কঠোর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। নয়তো, রাজশাহীবাসীর স্বার্থে আমরা সাংগঠনিকভাবে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হব।’
তবে কোন অনিয়ম হচ্ছে না দাবি করে এ বিষয়ে বালু মহালের ইজারাদার স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর রজব আলী বলেন, হাইকোট থেকে যে কোন স্থান থেকে বালু তোলার আদেশ পেয়েছি। সেই আদেশ বলে তালাইমারি এলাকায় বালু উত্তোলন করে পরিবহনের জন্য এই রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল বলেন, কোনভাবেই পদ্মার বুকে রাস্তা তৈরী করতে দেয়া হবে না। তারপরেও তালাইমারি এলাকার পদ্মায় বালু পরিবহনের জন্য রাস্তা নির্মাণ হচ্ছে এমন খবর পেয়ে গতকাল (মঙ্গলবার) জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলের উপস্থিত শ্রমিকরা সেই রাস্তা নির্মাণ কাজের সাথে জড়িত না থাকার কথা বলেছিলেন। এরপর তাদেরকে সেই রাস্তা নির্মাণ কাজে জড়িত হতে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরও যদি নিষেধাজ্ঞাকৃত এলাকায় রাস্তা নির্মাণ ও বালু উত্তোলন করা হয়, তবে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।