শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৫০ am
এম এম মামুন, নিজস্ব প্রতিবেদক :
নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ জয়িতা ও রাজশাহীর একমাত্র নারী পত্রিকা বিক্রেতা দিল আফরোজ খুকি ওরফে খুকি কবিতা আবৃত্তির মতো করে কথা বললেন পত্রিকা বিক্রিয় করতেন। বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুর আনুমানিক ১টা ২৫ মিনিটের দিকে নগরীর মিশনারিজ অব চ্যারিটি আশাদান মাদার তেরেসা আশ্রমে তার মৃত্যু হয়।
(ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
খবরের কাগজ বিক্রি করতে মানুষের কাছে গিয়ে নানা বিরূপ আচরণের শিকার হন খুকি। তার আত্মমর্যাদার জন্য লড়াইয়ের কথা না জেনে অনেকে তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন। বেঁচে থাকা অবস্থায় এক সাক্ষাৎকারে এসব কষ্টের কথা বললেছিলে খুকি। “আমি খবরের কাগজ বিক্রি করে নিজের জীবন চালাচ্ছি, এটা কি অসম্মানের? এটা কীভাবে অন্য কারো মানহানি করে? কোনো কাজই তো ছোট নয়।’’
দিল আফরোজ খুকি ৩০ বছর ধরে সংবাদপত্র বিক্রি করছেন। ষাটোর্ধ্ব উপর বয়স হলেও তিনি সংবাদপত্র বিক্রি করে চলেছেন। রাজশাহী নগরের শিরোইল এলাকায় তার বাড়ি। ১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। এলাকায় পাগলী বলে ডাকত তাকে কেউ কেউ। কারো দয়ার পাত্রী না হয়ে বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা। এজেন্টদের কাছ থেকে সংবাদপত্র সমগ্রহ করেন সকালে। সারাদিন শহরের বিভিন্ন রাস্তায়, অলিতে-গলিতে ঘুরে ঘুরে সংবাদপত্র বিক্রি করেন। মাইলের পর মাইল হাঁটেন। তার কাঁধে ঝুলে থাকতো সংবাদপত্র ভরতি একটি কাপড়ের ব্যাগ।
মানুষের কাছে উপহাস, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা পেলেও তিনি দমে যাননি। বরং সব সময় মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। অনেককে নগদ অর্থ ধারও দেন, যাদের বেশির ভাগই নারী। যাদের দান করেছেন তাদের বেশির ভাগের নাম মনে নেই বলে জানিয়েছিলেন দিল আফরোজ খুকি। কির ভাগ্নে শামস-উর রহমান রুমি বলেন, খুকি সাত বোন এবং পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে দশম। আশির দশকে টাঙ্গাইলের ভারতেশ্বরী হোমসে পড়াশুনা করেছেন। অল্প বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল এবং বিধবা হয়েছিলেন কম বয়সেই। তিনি তার স্বামীর মৃত্যুতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৯১ সালে তিনি তৎকালীন (বর্তমানে বন্ধ) রাজশাহীর আঞ্চলিক ‘সাপ্তাহিক দুনিয়া’ পত্রিকা বিক্রি করা শুরু করেছিলেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আহমেদ শফি উদ্দিন সাপ্তাহিকের অন্যতম কর্ণধার ছিলেন। খুকির বোনের স্বামী আবদুল আজিজ তাকে আহমেদ শফি উদ্দিনের কাছে নিয়ে যান একটি চাকরির অনুরোধ নিয়ে। তিনি ২০ কপি দিয়ে শুরু করে সপ্তাহে ৫০০ কপি পত্রিকা বিক্রি করতেন। পত্রিকার পক্ষ থেকে তাকে স্বর্নপদক দেওয়া হয়েছিল। তারপর তিনি শহরের অন্যান্য স্থানীয় দৈনিকও বিক্রি শুরু করেন। তিনি নগদ টাকা দিয়ে খবরের কাগজ কিনতেন, কখনও বাকি রাখেন না। কারো কাছ থেকে সহায়তা নেন না, নেওয়াটা অসম্মান বলে মনে করেন। বরং তিনি যাদের প্রয়োজনে মানুষকে দান করতেন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) শামীম আহমেদ তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, “তার ইচ্ছে অনুযায়ী নগরীর টিকাপাড়া কবরস্থানে বাদ মাগরিব দাফন করা হয়েছে।”
গত ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে নগরীর লক্ষ্মীপুর মোড় থেকে দিল আফরোজ খুকিকে উদ্ধার করে রামেক হাসপাতালের ৩৭নং ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে পরদিন (রোববার) সকালে তাকে ৭ নম্বর ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। হাসপাতালে কোনো বিছানা না পাওয়ায় বারান্দাতেই তার চিকিৎসা চলছিল। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর ‘পত্রিকা বিক্রি করা সেই খুকি আপা রামেক হাসপাতালে ভর্তি’ শিরোনামে বিভিন্ন মিডিয়াতে নিউজ প্রকাশ হলে বিষয়টি অনেকের সুনজরে আসে। পরে ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের পক্ষে মেয়রপত্নী ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নারী নেত্রী শাহীন আকতার রেণী খুকিকে দেখতে যান। তিনি খুকির চিকিৎসার খোঁজ নেন এবং বেডের ব্যবস্থা করে দেন। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ২২ ডিসেম্বর তাকে রামেক হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউতে) পাঠানো হয়। সেখান থেকে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি তাকে সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। এরপর ১৯ ফেব্রুয়ারি রামেক হাসপাতাল থেকে মিশনারিজ অব চ্যারিটি আশাদান মাদার তেরেসা আশ্রমে পাঠানো হয় খুকিকে।
দিল আফরোজ খুকি রাজশাহী মহানগরীর একমাত্র নারী সংবাদপত্র বিক্রেতা। ষাটোর্ধ্ব এই নারী দিনভর পরিশ্রম করলেও অনেক কষ্টে জীবনযাপন করেন। ২০২০ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুকির জীবন-সংগ্রামের একটি ভিডিও প্রকাশ পাওয়ার পর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আসে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে জেলা প্রশাসন খুকির পাশে দাঁড়ায়। এছাড়াও ২০২০ সালে শ্রেষ্ঠ জয়িতার পুরস্কার পান জীবন সংগ্রামের অদম্য এই নারী। সবাই তার জন্য দোয়া করবেন। রা/অ