শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:২১ am
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় মামলার পর দেশে ও বিদেশে এ আইনের নিন্দা করে যেসব বক্তব্য প্রকাশিত হচ্ছে, তা মোটেই বিস্ময়কর নয়। একই সময়ে যুগান্তর পত্রিকার সাংবাদিক মাহবুব আলম লাবলুর বিরুদ্ধেও চট্টগ্রামে এ আইনের আওতায় মামলা করা হয়েছে।
এ পটভূমিকায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন এবং অনলাইনে সমালোচকদের কণ্ঠ রোধ করতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।’
২০১৮ সালে কার্যকর হওয়া এ আইনের খসড়া প্রণয়নের সময়ই এ নিয়ে উদ্বেগ-আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। তখনই বলা হয়েছিল যে এই আইন নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান না করে কণ্ঠ রোধ করবে। এই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া, কার্যকর করার বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং এ বিষয়ে প্রতিবাদ—কিছুই সরকারের অবস্থানে ন্যূনতম পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। এ আইন যে সাংবাদিকতার জন্য এক ‘দুঃস্বপ্নে’ রূপ নেবে, দেশের সম্পাদক পরিষদের নেতারা আগেই বলেছিলেন। বাস্তবেও তাই-ই হয়েছে।
এসব সমালোচনা এবং বাস্তবে এই আইনের ভয়াবহ ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে সরকারের মন্ত্রীরা মাঝেমধ্যে ‘এই আইনের কিছু অংশের অপপ্রয়োগ হচ্ছে’, ‘এই আইনের সংশোধন করা হবে’ বলে মন্তব্য করে থাকেন। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত বৃহস্পতিবার বলেছেন যে নওগাঁয় র্যাবের হেফাজতে ‘নিহত’ সুলতানা জেসমিনের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়েছে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা তারই ধারাবাহিকতা হলেও এর বার্তাটি আরও কঠোর। এই বার্তা কেবল সাংবাদিকদের জন্য নয়, এই বার্তা একদিকে দেশের মানুষের জন্য, অন্যদিকে যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতিও। প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলোই কেবল বিবেচ্য নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে মতিউর রহমান নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।
১৪ মার্চ নাগরিকদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার সময় বলেছেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) সমস্যা দূরীকরণে আলোচনা চলছে, সেখানে সব পক্ষের কথা শোনার চেষ্টা করা হচ্ছে।’ কিন্তু অতীতে ‘সকলের কথা শোনা হবে’ ধরনের প্রতিশ্রুতি যে নেহাতই শিশু ভোলানো ছড়ার মতো বলা হয়েছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। কেননা, এই আইন প্রণয়নের সময় মন্ত্রীরা সাংবাদিক নেতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তাঁদের আপত্তিগুলো বিবেচনা করা হবে। কিন্তু তাঁদের কথাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। সরকার বা মন্ত্রীরা এ নিয়ে কোনো রকম ব্যাখ্যা দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি।
দুর্ভাগ্যজনক যে সাংবাদিক নেতারা এ নিয়ে মন্ত্রীদের প্রশ্ন করেছেন, এমন শোনা যায়নি। খসড়া আইন এবং সংসদে পাস হওয়া আইনের মধ্যকার পার্থক্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, সাংবাদিক নেতাদের কথাকে অগ্রাহ্য করা হলেও পুলিশের আপত্তি অগ্রাহ্য করা হয়নি। এ আইনের খসড়ায় এ আইনের প্রয়োগে, বিশেষত কাউকে আটকের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদন নেওয়ার যে বিধান রাখা হয়েছিল, তা পুলিশের আপত্তির কারণে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক স্বীকার করেছিলেন, এ আইনের ‘অপপ্রয়োগের’ ঘটনা ঘটছে ও আইন সংশোধন করা হবে। তিনি বলেছিলেন, তাঁর মন্ত্রণালয়ের বিচার বিভাগের সচিবের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছেন এবং এ কমিটি আইনের দুর্বলতা বা সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে ও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করবে। এ আলোচনায় কী অগ্রগতি হয়েছে, তা কেউই জানেন না।
কিন্তু এখন ফলকার টুর্কের বিবৃতিতে আমরা জানতে পারি, ‘বাংলাদেশ সরকার এ আইনের অপপ্রয়োগ বন্ধে সুরক্ষাকবচ রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।’ সেই প্রতিশ্রুতি যে পালিত হয়নি, সেটাও তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আমরা মনে করতে পারি যে সাংবাদিকদের আটকের ক্ষেত্রে আইনের ব্যতিক্রম করা হবে বলে আইনমন্ত্রী বলেছিলেন। কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য যে কোনো ধরনের আইনেরই বরখেলাপ, সে বিষয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করা হয়নি।
শামসুজ্জামান শামসের ক্ষেত্রেই শুধু নয়, আগেও আমরা দেখেছি উল্কার গতিকে হার মানিয়ে এ আইনের আওতায় নাগরিকদের আটক করা হয়েছে; সুলতানা জেসমিনের বিরুদ্ধে এমনকি কাগজে-কলমে থানায় মামলারও দরকার হয়নি—একজন সরকারি কর্মচারীর মুখের কথাই যথেষ্ট ছিল।
পেশাগত গবেষণা ও আগ্রহের কারণে এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে নাগরিকদের মতপ্রকাশের অধিকার বিষয়ে নজর রাখার চেষ্টা করে আসছি। ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনের পর থেকে এ আইনের প্রয়োগ বিষয়ে এবং ২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রণয়নের পর থেকে ঘটনাবলি ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেছি।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজে (সিজিএস) আমি একটি গবেষণা প্রকল্পের সূচনা করি। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে এ প্রকল্পে আমরা এ আইনের আওতায় কারা অভিযুক্ত হচ্ছেন, কারা আটক হচ্ছেন, কারা দোষী সাব্যস্ত হচ্ছেন—তার তথ্য সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত আছি। প্রকল্পের আওতায় ইতিমধ্যে আমরা তিনটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি, ২০২১ সালের এপ্রিলে, ২০২২ সালের এপ্রিলে এবং ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে।
সর্বশেষ জানুয়ারি ২০২৩-এর প্রতিবেদনে ২০১৮-এর অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এ সময়ে ১ হাজার ১০৯টি মামলার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পেয়েছি, যাতে ২ হাজার ৮৮৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং ১ হাজার ১১৯ জন আটক হয়েছেন। এগুলোই সব মামলা নয়, কেননা এ ধরনের মামলার আলাদা হিসাব সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
গবেষণায় দেখেছি যে এ মামলায় অভিযুক্ত হন সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। কিন্তু তাঁদের মধ্যে রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকের হার সবচেয়ে বেশি। আমরা এ-ও দেখেছি, অভিযুক্ত ৫১ জন শিক্ষকের ৩৮ জন, অর্থাৎ ৭৪ শতাংশই অভিযুক্ত হওয়ার পরই আটক হয়েছেন। কমপক্ষে ২৬ জন অভিযুক্ত হয়েছে, যাদের বয়স ১৮-এর কম। ২৮০ জন সাংবাদিক অভিযুক্ত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ৮৪ জন আটক হয়েছেন। ৪৭ মাসের তথ্যে এ আইনের প্রয়োগের কিছু প্রবণতা শনাক্ত করা গেছে, যা উল্লেখযোগ্য।
১. এ আইন নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়নি, বরং সুরক্ষা দিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীদের। ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমপিদের মান-ইজ্জত রক্ষা করবে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে, নেতা ও মন্ত্রীদের সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে বা গণমাধ্যমে যেকোনো ধরনের সমালোচনা হলেই মামলা করা হয়েছে এবং আটক করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘কটূক্তি’ করার অভিযোগে ১৪০টি মামলা হয়েছে, ২১০ জন অভিযুক্ত হয়েছেন এবং ১১৫ জন আটক হয়েছেন। মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি বা তাঁদের অবমাননার অভিযোগে ৬৪ মামলায় অভিযুক্ত ১৩০ জনের মধ্যে ৫১ জন আটক হয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মানহানির অভিযোগে ১৬৮ মামলায় অভিযুক্ত ৪৭০ জন, আটক হয়েছেন ১২০ জন।
২. এই আইনে যে-কেউ যার বিরুদ্ধে ইচ্ছা মামলা করতে পারছে। একে ইংরেজিতে বলে ‘ভিজিল্যান্টি জাস্টিস’। এ কারণে সবার মধ্যে ভয় তৈরি করা গেছে। এই আইনে মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায়ের ঘটনাই শুধু ঘটেনি, কেবল পুলিশ যে-কাউকে হেনস্তা করতে পারছে, তা-ই নয়; এটি হয়ে উঠেছে ভিন্নমতের মানুষকে শায়েস্তা করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কর্মীদের হাতিয়ার। প্রতি মাসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা গড়ে ৪ দশমিক ২১টি করে মামলা করেছেন।
৩. এই আইন সরকার যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে। আমাদের গবেষণায় যে ৬৩৬ জন অভিযোগকারীর পেশা পাওয়া গেছে, তার মধ্যে সরকার–সংশ্লিষ্টরা ১৯২টি মামলা করেছেন।
৪. এই আইন নাগরিকদের যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় আটক করার, তল্লাশি করার, তাঁদের ফোন বা ল্যাপটপ নিয়ে যাওয়ার অধিকার পুলিশকে দিয়েছে। যার সূত্রে কোনোরকমের অভিযোগ ছাড়াই অনেককে আটক করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে শামসুজ্জামান ও সুলতানা জেসমিনের ঘটনা।
৫. এই আইনে আটক হওয়ার পরে হেফাজতে নির্যাতন চালানোর ঘটনার সবচেয়ে বড় উদাহরণ লেখক মুশতাক আহমদ ও সুলতানা জেসমিনের মৃত্যু। কার্টুনিস্ট কিশোরও এ অভিযোগ করেছেন।
৬. এই আইনে অভিযুক্ত হওয়ার পরে আইনে বিচারাধীন অবস্থায় কারাগারে আটক রাখা হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৭৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার বিধান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানা হয় না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এসব বৈশিষ্ট্যকে সরকার ও সরকার সমর্থকেরা ‘অপপ্রয়োগ’ বলে দাবি করলেও সাড়ে চার বছর ধরে অব্যাহতভাবে এ ধরনের ঘটনা ‘আইনি’ভাবেই সম্পাদিত হয়েছে। এর কারণ হলো এ আইনের উদ্দেশ্য ভীতি তৈরি করা এবং নাগরিকের মাথার ওপরে খড়্গ ঝুলিয়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই এই আইন করা হয়েছে, প্রয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে এই আইন প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা তারই ধারাবাহিকতা হলেও এর বার্তাটি আরও কঠোর। এই বার্তা কেবল সাংবাদিকদের জন্য নয়, এই বার্তা একদিকে দেশের মানুষের জন্য, অন্যদিকে যেকোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের প্রতিও। প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথম আলোই কেবল বিবেচ্য নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে মতিউর রহমান নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার। সূত্র : প্রথম আলো