সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:২৯ pm
ডেস্ক রির্পোট :
সংগ্রামের মাসের অর্ধেকটা সময় পেরিয়ে গেছে ততদিনে। চারদিক উত্তাল। বঙ্গবন্ধুর নানা নির্দেশনা জনগণ কার্যকর করছে, আর নতুন নির্দেশনার অপেক্ষা করছে। সুপ্ত আগুনে ফুঁসছিল গোটা দেশ। এই সময়টা ছিল মুক্তিপাগল বাঙালির অন্যরকম একটা অপেক্ষা। শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষায় ছিল তারা।
১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ সকাল পৌনে ১১টার দিকে ধানমন্ডির বাড়ি থেকে বঙ্গবন্ধুর গাড়ি বের হলো। শোক আর প্রতিবাদের প্রতীক কালো পতাকা উড়ছে বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত গাড়ির ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে, আর উইন্ড ক্রিনে বাংলাদেশের প্রস্তাবিত পতাকা। সে এক অনন্য শক্তি জাগানিয়া সময়। অসংখ্য বাঙালি হত্যার প্রতীকী প্রতিবাদ হিসেবে গাড়িতে কালো পতাকা উড়িয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বৈঠক করতে যান বঙ্গবন্ধু।
স্বাধীনতার মাস অগ্নিঝরা মার্চে দৈনিক ইত্তেফাক পুরো সময়জুড়েই নানা কর্মসূচি বিস্তারিত তুলে ধরার কাজটি করতো। ১৯৭১ সালের ১৭ মার্চ প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতার মূল খবরের শিরোনাম ছিল, ‘জাতির ভাগ্য নির্ধারণী আলোচনা শুরু’। ১৬ তারিখে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকের খবর দেওয়া হয় এতে। বাংলার মুক্তিকামী জনতার সর্বাত্মক অহিংস আন্দোলনের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের ১৬ মার্চ ঢাকার প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা শেষে বাইরে এসে সমবেত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব জানান, ১৭ মার্চ ১০টায় তারা পুনরায় বৈঠকে বসবেন। মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একটি স্থিরচিত্র প্রকাশিত হয় ইত্তেফাকের ১৭ মার্চের প্রথম পাতায়। এর ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘দুই-এক মিনিটের ব্যাপার নয়, যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। তাই আরও আলোচনা চলবে।’ প্রেসিডেন্ট ভবনের বাইরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি একথা বলেন।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’গ্রন্থে সেই ঘটনা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘হুড়মুড়িয়ে উঠে নিচে ছুটলাম। খবর খানিকটা হয়ে গেছে। শেখ মুজিবের গাড়িটা প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসছে। সাদা ধবধবে গাড়িতে পতপত করে উড়ছে কালো পতাকা। দেখে প্রাণটা যেন জুড়িয়ে গেলো। প্রতিবাদের কালো পতাকা উঁচিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় গিয়েছেন শেখ মুজিব। এর আগে কোনোদিনও পাকিস্তান সরকার বাঙালির প্রতিবাদের কালো পতাকা স্বীকার করে নেয়নি। এবার সেটাও সম্ভব হয়েছে।’
সেদিন প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে নিজ বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু দলের শীর্ষস্থানীয় সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। গভীর রাত পর্যন্ত আলোচনা চলে।
টেবিলের আলোচনা ছাড়িয়ে তখন আন্দোলন মাঠে, দেশে, দেশের বাইরে। সংবাদ সংস্থা এএফপির খবরে সেদিন বলা হয়, ভারত সরকার তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে সব বিদেশি বিমানের পূর্ব পাকিস্তানে যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিদেশি বিমানে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পরিবহন বন্ধ করার জন্যই এ ব্যবস্থা।
পরের দিনের (১৭ মার্চ) পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ১৬ মার্চ ঢাকায় আর্ট কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সভা করেন। সভা শেষে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে মিছিল হয়। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আগে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠনে পিপিপি চেয়ারম্যান ভুট্টোর প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করে এদিনও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতারা বিবৃতি দেন।
করাচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ বলেন, ‘গণতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দল একটি, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে, অন্যের কাছে নয়।’
১৬ মার্চ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের আলোচনার পাশাপাশি সারা দেশে আন্দোলন বাঁধভাঙা রূপ নেয়। রাজপথ মিছিলে মিছিলে উত্তপ্ত করে রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষজনও দেশের উদ্ভূত সমস্যার চূড়ান্ত সমাধানে বঙ্গবন্ধুর সর্বশেষ মন্তব্যের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ১৬তম দিনে বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ এলো—এখন থেকে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক কেন্দ্রের শুল্ক, কর, আবগারি কর ও বিক্রয় কর গ্রহণ করবে। কিন্তু এসব কর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানে জমা দেওয়া হবে না।
এভাবেই অসহযোগ আন্দোলন তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যায়। দেশের সর্বত্র উড়ছিল কালো পতাকা। গড়ে উঠতে থাকে সংগ্রাম কমিটি। সব বয়স সব পেশা ও শ্রেণির মানুষ বেরিয়ে আসতে থাকে রাজপথে।
স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বঙ্গবন্ধুকে আরও উজ্জীবিত করতে রাস্তায়, মাঠে- ময়দানে তখন গণসংগীত, নাটক, পথনাটক ও পথসভা করে চলছে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বেতার-টেলিভিশন শিল্পী সংসদ, মহিলা পরিষদ প্রভৃতি সংগঠন। সূত্র : বাংলাট্রিবিউন