বৃহস্পতিবর, ২১ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:৩৫ pm
ডেস্ক রির্পোট :
পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম, নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে নানারকম অনিয়ম-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং সহকর্মীদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে।
তাদের এ সকল কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ কর্মচারীরা পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। আর অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে আগামীকাল রোববার (১২ মার্চ) দু’দিনের পাবনায় আসবে দুই সদস্যের একটি তদন্ত দল।
লিখিত অভিযোগ ও তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পর্যায়ক্রমে পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নানাভাবে ঠিকাদারদের হয়রানী করে আসছেন। বিভিন্ন সময়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ প্রদানের আগেই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয় এই চক্রটি।
এছাড়াও আউটসোর্সিংয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী নিয়োগেও রয়েছে তাদের স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের দাপট। পাশাপাশি অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে চরম দূর্ব্যবহার করেন। তুচ্ছ বিষয়ে চাকুরিচ্যুত করা ও বদলীর হুমকি দিয়ে আসছেন।
এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বিভিন্ন সেচ ক্যানেল (জমি) লিজ দেওয়া বন্ধ থাকার পরও মৌখিক ও লিখিতভাবে অনুমতি দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন এই কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মচারীদের অভিযোগ, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমান আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের নানাভাবে নাজেহাল করছেন। ইচ্ছেমতো তাদের ব্যবহার করছেন। নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের নিজ নিজ দায়িত্বে না দিয়ে তাদের দেহরক্ষী ও ব্যক্তিগত কাজ করানোসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করছেন। চালকদের গাড়ী না দিয়ে, গেট অপারেটরকে গেটে না রেখে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছেন।
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সুত্র জানায়, পাবনা পওর বিভাগের আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে নিয়োগপ্রাপ্ত ২৪ জন কর্মচারীদের মধ্যে ৮ জন গেট অপারেটর, ৪ জন ক্লিনার, ৩ জন ড্রাইভার, ৩ জন খালাশি, ৪ জন চৌকিদার, ১ জন কুক ও ১ জন পাম্প অপারেটর রয়েছে। ইতিপূর্বে ২ জন আউটসোর্সিং কর্মচারীকে বিনা দোষে বাদ দিয়ে নিজ এলাকার ২ জনকে নিয়োগ দেন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম।
ভূক্তভোগী কুক ফজলুল হক ও গেট অপারেটর শীতল কুমার সরকার বলেন, এই অফিসে কিছু গেট অপারেটর ও চৌকিদারদের মধ্যে কেউ কেউ সঠিকভাবে অফিস করেন না। তারা বিভিন্ন অজুহাতে কতিপয় ওই সকল কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে বাড়িতে বসে থেকে বেতন নিচ্ছেন। আউটসোর্সিং নিয়োগে নির্বাহী প্রকৌশলীর শ্যালক নাসিরকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে বসতে দেয়া হয়েছে রাজকীয় কক্ষে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমান তাদের অপছন্দের বোর্ডের নিয়মিত কর্মচারী ও আউটসোর্সিং কর্মচারীদের সাথে খারাপ ব্যবহারসহ চাকুরিচ্যুত করার হুমকি ধামকি দিয়ে আসছেন।
একাধিক কর্মচারী জানান, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের নানা অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, সীমাহীন দূর্নীতির বিষয়টি নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবহিত করা হলেও, অজ্ঞাত কারণে তিনি কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তাদের অভিযোগ, আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন অনিয়মের সাথে উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ওতপ্রোতভাবে জড়িত হওয়ার কারণে কার্যত কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।
সূত্র জানায়, নির্বাহী প্রকৌশলী সরোয়ার জাহান সুজন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমানের যোগসাজসে জেলার কাশিনাথপুর-রসুলপুর এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ইরিগ্রেশন সেচ ক্যানেলের মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক বিঘা জমি অনিয়মতান্ত্রিক উপায়ে অর্থ নিয়ে সুতি জালের মাধ্যমে মৎস্য চাষের জন্য দেয়া হয়েছে। অথচ এই অবৈধ সুতি জাল উচ্ছেদের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমেই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সেখানেই অবৈধভাবে অর্থ হাতিয়ে এই সুতি জাল দিয়ে আবারও মাছ চাষের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
জেলার সুজানগর উপজেলার রসুলপুর, চব্বিশ মাইল, কাশিনাথপুর, চিনাখড়া, বনগ্রামসহ বেশ কয়েকটি হেড রেগুলেটর রয়েছে। ওই সকল স্থানে অবৈধভাবে সুতি জাল দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। ফলে সেচ কাজে পানি প্রবাহের কাজ ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
চব্বিশ মাইল, কাশিনাথপুর ও চিনাখড়া এলাকায় কয়েকজন মাছ চাষীর সাথে কথা বললে তারা বলেন, মাঝে মধ্যে গেট অপারেটররা স্লুইসগেট ছেড়ে দিয়ে আমাদের মাছ চাষে ক্ষতি করছেন। ক্ষতি কেন করছেন জানতে চাইলে তারা বলেন, আমরা তো পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসারদের টাকা দিয়ে মাছ চাষ করছি। তাহলে আমাদের কেন ক্ষতি করা হচ্ছে।
কর্মকর্তা, কর্মচারী ও একাধিক ঠিকাদারের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, সীমাহীন অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিটা কাজের প্রতিটা পদক্ষেপে টাকা গুনতে হয়। টাকা না দিলে নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়। অফিসের উর্ধ্বতন এই কর্মকর্তারা শুধু ঠিকাদারকেই নয়, তাদের অধীনস্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও বাদ যান না তাদের হয়রানী আর নাজেহাল থেকে। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম কর্তৃক হয়রানী ও নাজেহাল থেকে মুক্তি পাবার জন্যে বেড়া পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীসহ সকল কর্মকর্তা স্ব-স্ব অন্যত্র বদলীর জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু, এই বদলীর আবেদনগুলো তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম কার্যকর হতে দেননি।
তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের বিরুদ্ধে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বরাবর কর্মচারীদের লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে, পাবনায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হয়ে আসার পর থেকে পাবনার ৩ জন নির্বাহী প্রকৌশলীসহ অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে অশালীন আচরণ, দূর্বব্যহার এবং বিনা কারণে একাধিকবার শোকজ করেছেন। ইছামতি নদী খননে ডিপিপি অনুমোদনের আগেই ঠিকাদারের কাছ থেকে বড় অংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বেড়ায় চলমান যমুনা নদীর তীর সংরক্ষণ কাজে ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করেছেন। তিনি নিজ ক্যাম্পাসে এআর মার্ক বাসা বরাদ্দ থাকলেও সেটি জোরপূর্বক ক্ষমতার দাপটে উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী, নির্বাহী প্রকৌশলী ও উপ-সহকারী প্রকৌশলীকে ওই বাসা চিঠির মাধ্যমে পরিত্যক্ত ঘোষণা করিয়ে তিনি রেষ্ট হাউজে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীদের জোরপূর্বক বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো ও নিজ এলাকার মানুষকে মোটা টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দিয়েছেন। একইভাবে আগামী জুনে পরবর্তী নিয়োগেও পাবনার আউটসোর্সিংয়ের কর্মচারীদের বাদ দিয়ে নিজের এলাকার কর্মচারী নিয়োগ করতে পায়তাঁরা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলমের নানা অনিয়ম, দূর্নীতির লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই তদন্ত টিমের প্রধান করা হয়েছে রংপুর পওর’র সার্কেল-২ এর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আবু তাহেরকে। তার সাথে সহকারী হিসেবে রয়েছেন ওই দপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) এসএম শাখাওয়াত রহমান। এই টিম আগামী ১২ ও ১৩ মার্চ দুইদিন পাবনায় এসে তদন্ত করবেন।
অন্যদিকে এই তদন্ত টিম আটকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন পাবনার এই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম। ইতোমধ্যে তিনি পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন, নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) নওফেল উদ্দিন ও বেড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুধাংশু কুমার সরকারকে নিয়ে গোপন বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে তিন নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক তার বিষয়ে যে সকল অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে সেগুলো সঠিক নয় বলে মুচলেকা লিখে নিয়েছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
এসকল অভিযোগের বিষয়ে ভারপ্রাপ্ত উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী খলিলুর রহমান জানান, অভিযোগ সঠিক নয়। আর এসবের সাথে আমি জড়িত নই।
পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী সারোয়ার জাহান সুজন বলেন, অভিযোগ গুলো মনগড়া ও বানোয়াট। আমার সুনাম ক্ষুন্ন করতে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে।
এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কোহিনুর আলম বলেন, আমি ঢাকাতে আছি। অভিযোগগুলো শুনলাম। অফিসে আসেন কথা বলা যাবে। মোবাইলে অভিযোগের বিষয়ে কোন কথা বলতে পারবো না বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। সূত্র : পদ্মাটাইমস