শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০১:৩৯ pm
বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণ। আর এ তেরো পার্বণের সূচনা হয় এমনই এক ঋতুতে, চারদিকে নতুন পাতা আর ফুলের সমাহার। পাতাঝরা শুষ্ক শীতের শেষে আসে রঙে রঙিন বসন্ত। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব নিয়মিত আয়োজন করে আসছে।
পহেলা ফাল্গুন বাংলা পঞ্জিকার একাদশতম মাস ফাল্গুনের প্রথম দিন ও বসন্তের প্রথম দিন। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই ফেব্রুয়ারি পহেলা ফাল্গুন পালিত হয়। এ বসন্তকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাংলাদেশে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। প্রকৃতির দক্ষিণা দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে আজ বসন্তের গান। ফুলে ফুলে ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। সব কিছুই জানান দিচ্ছে আজ পহেলা ফাল্গুন। ফাল্গুনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন।
ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির আজ এত বর্ণিল সাজ। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির সাথে তরুণ হৃদয়েও লেগেছে দোলা। সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতি। তাই কবির ভাষায়- ‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত’। আবাল-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উন্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা।
বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় মেলা, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকবে। ভালোবাসার মানুষেরা মন রাঙাবে বাসন্তী রঙ্গে। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও। বসন্তের আনন্দযজ্ঞ থেকে বাদ যায় না গ্রাম্যজীবনও। আমের মুকুলের সৌরভে আর পিঠেপুলির মৌতাতে গ্রামে বসন্তের আমেজ একটু বেশিই ধরা পড়ে। বসন্তকে তারা আরও নিবিড়ভাবে বরণ করে। চারিদিকে যেন সাজ সাজ রব। বসন্তের আগমন মানেই তরুণ হৃদয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার।
বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্ত রঙিন পুষ্পিত রক্তের স্মৃতির ওপরও রং ছড়ায়। ১৯৫২ সালের আট ফাল্গুন বা একুশের পলাশ রাঙা দিনের সঙ্গে তারুণ্যের সাহসী উচ্ছ্বাস আর বাঁধভাঙা আবেগের জোয়ার যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বঙ্গাব্দ ১৪০১ সালে ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপনের পর সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। এ ছাড়া তরুণ-তরুণীরা বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর, পাবলিক লাইব্রেরি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখবে সারাদিন। আজ দিনভর চলবে তাদের বসন্তের উচ্ছ্বাস প্রকাশ। ফোন, ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে বসন্তের শুভেচ্ছা বিনিময়। আজ নানা আয়োজনে বসন্তকে বরণ করবে বাঙালি।
কবিগুরুর ভাষায় বলা যায়, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে/কোরো না বিড়ম্বিত তারে’। প্রকৃতি চলছে তার আপন নিয়মে। ফুলপ্রধান এলাকায় ফুল বিক্রিরও লেগেছে হিড়িক। সবমিলিয়ে ফুলের রঙেই কাটবে আজ সারাবেলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলাও পরিণত হবে মানুষের বাসন্তী রঙের প্রাঙ্গণে। ফুলের সুভাসে ও সবুজ প্রাঙ্গণে মেতে থাকবে রাজধানী-বাসী। সব কুসংস্কার পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে এসেছে। পহেলা ফাল্গুন আমাদের মনে করায়- আমরা বাঙালি, এই দুই উৎসব আমাদের রক্তে জাগায় বাঙ্গালিয়ানার নবজাগরণ। আর সেই বাঙালি চেতনা জাগ্রত করতেই আমরা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে, সাজি ফুলের সাজে। মেয়েদের কপালের সিঁদুরে কুমকুমের টিপ, আর পায়ের আলতা, হাতে চুরি, খোপায় ফুল আমাদের মনে করায়- আমরা বাঙালি।
আমরা সারাবছরের জীবন-যুদ্ধ ভুলে মেতে উঠে ফাগুন উৎসবে। আমাদের পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে আমরা রয়েছে, ‘মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়, খোঁপায় জড়ালো কলমির লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়’। বসন্ত উৎসব শুধু বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খ- ও উড়িষ্যাসহ আরও কিছু রাজ্যে উদযাপিত হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্তোৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। আমাদের ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে নানারকম সংকটের মধ্যে দিয়ে যাই। আবার কখনও মৌলবাদ, কখনও সাম্প্রদায়িক অহিংসা আর জঙ্গিবাদ এসে বাঙালির অহিংস আর উৎসবমুখর স্বত্বাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে।
এইসব হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হতে পারে বাঙালির জাতীয় উৎসবগুলোতে বাংলার চিরন্তন সাজে সেজে পথে নামা। তাই আসুন আমরা এবারের ফাগুন রাঙাই উৎসবের রঙে, অহিংসা আর প্রেমের সংগীতে নেচে-গেয়ে, আনন্দে মেতে। বসন্ত শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলেই উচ্ছ্বাসের রং ছড়ায় না, আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে শহীদদের রক্তের উপরও রং ছড়ায়। এই বসন্তে বাঙালির দ্রোহ প্রেম আর দেশপ্রেমের অনন্য নজির রয়েছে। কেননা আমাদের ভাষা- স্বাধীনতা সংগ্রাম এই বসন্তে শুরু হয়েছিল।
তাই এই বসন্তে বাঙালি হৃদয় কিছুতেই ঘরে থাকে না। যেমনি থাকেনি- বায়ান্ন ও একাত্তরে। যেকোনো সংকটে বাঙালিকে জেগে উঠতে এই বসন্ত সাহস যুগিয়েছে। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে বিশ্ব দরবারে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে সামনে এগিয়ে যাবে এই মর্মে আমাদের কাজ করতে হবে, বসন্তের উল্লাস বয়ে যাক সকল বাঙ্গালির প্রাণে। সূত্র : এফএনএস