শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:২১ am
বর্তমানে সারা বিশ্বে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ বিগত তিন মিলিয়ন বছরের মাঝে সর্বোচ্চ, এবং বায়ুদূষণ যে হারে বৃদ্ধি পাঁচ্ছে, গত ৬৬ মিলিয়ন বছরেও দেখা যায় নি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে এর প্রভাব দেখা গেলেও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার র্শীষে অবস্থান করছে আমাদের বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। আবহাওয়ার পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণে দিন দিন যেন ঢাকায় নির্মল বাতাস পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
২০২৩ সালের নতুন বছর শুরু হতে না হতেই জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন থেকে টানা ২৫ তারিখ পর্যন্ত একদিনও বিশুদ্ধ বাতাস পাননি এ রাজধানীবাসী। বাংলাদেশের রাজধানীর বাতাস এতোটাই দূষিত যে গত ছয় বছরে মাত্র ৩৮ দিন বিশুদ্ধ বাতাস মিলেছে এবং ইট পাথরে ঘেরা ব্যস্ত মানুষেরা বছরের গড়ে মাত্র ছয় দিন বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৫ জানুয়ারি ঢাকার বাতাস ছিল সবচেয়ে বেশি দূষিত এবং দেশে উচ্চমাত্রার বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর মারা যাচ্ছে প্রয় ৮০ হাজার মানুষ। বায়ুদূষণে বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, কাশি, নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণ ও বিষণ্ণতার ঝুঁকি। এ স্বাস্থ্যগত হুমকি বাড়ার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ও বয়স্করা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থাতে রয়েছেন। একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে কাটিয়ে দেয়, তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। এখন শুধু ঢাকা শহরই নয়, বায়ুদূষণের এই সমস্যা এখন সমগ্র বাংলাদেশে। যেসব এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানার উপস্থিতি রয়েছে, রাস্তা নির্মাণ ও মেরামতের কাজ চলমান, মেট্রোরেলের কাজ চলমান, ফ্লাইওভারের কাজ চলছে এবং কয়েকটি রাস্তার সংযোগ যেখানে ঘটেছে সেসব জায়গায় মাত্রাতিরিক্ত হারে বায়ুদূষণ হচ্ছে। এমনকি লঞ্চঘাট, ফেরিঘাট, বাস টার্মিনালেও প্রচুর বায়ুদূষণ লক্ষ করা যায়।
বায়ুদূষণে আবহাওয়া জনিত ও ভৌগোলিক কারণ ছাড়াও নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা ও আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতাসহ মানবসৃষ্ট নানা কারণও রয়েছে। এরমধ্যে ঢাকা শহরের বায়ুর মান সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকে রাতে। বিকেল ৪টার পর থেকে বায়ুর মান খারাপ হতে শুরু করে, রাত ১১ টা থেকে ২ টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ খারাপ অবস্থায় পৌঁছে এবং গত এ ছয় বছরে রাত ১টার সময় বায়ুমান সূচক ছিল ১৬২। রাত ১০টার পর উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রচুর মালবাহী ট্রাক ঢাকায় প্রবেশ করে। এতে রাতে প্রচুর বায়ুদূষণ হয়। এছাড়াও রাতে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা শহরের রাস্তা ঝাড়ু দেয়ায় বাতাসে ধুলাবালি উড়তে থাকে। রাত ৩টার পর থেকে বায়ুর মানের উন্নতি হয়। তবে অফিসগামী মানুষ এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের চাপে সকাল ৬টা থেকে ৯টা পর্যন্ত বায়ুদূষণে একটি ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা থাকে। সকাল ১০টার পর থেকে বায়ুদূষণ ক্রমান্বয়ে বিকাল ৪টা পর্যন্ত কম দেখা যায়। ঢাকার বাতাসে দূষণে মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে, নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া ও ফিটনেসবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল, মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি, ইট-ভাটার ধোঁয়া, সড়কের নিয়ন্ত্রণ-হীন খোঁড়াখুঁড়ি, অবকাঠামো ও মেগা প্রজেক্টের নির্মাণযজ্ঞ, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, কঠিন বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা ও বর্জ্য পোড়ানো প্রভৃতি। এ ছাড়া ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার জলাভূমি ভরাট এবং সবুজ এলাকা ও সবুজায়ন কমে যাওয়া, নিয়ন্ত্রণহীন অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণ, নগর ও পরিবেশের ভারবহন ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, পার্ক-উদ্যান-খেলার মাঠে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়ে কংক্রিটনির্ভর উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, যানবাহনের নিয়ন্ত্রণহীন গতি প্রভৃতি কারণে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণহীন মাত্রায় চলে গিয়েছে বলে জানা যায় ও বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে-সাধারণত শীতের মৌসুমে গড় বায়ুদূষণ সূচক বাড়ে। জুন ও জুলাইয়ে বায়ুদূষণ কমে আসে। শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু হওয়ায় এই সময়ে ধুলাবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে ইট ভাঁটা ও সিমেন্ট কারখানা থেকে উৎপন্ন ধুলার মিশ্রণ ঘটলে আশঙ্কাজনক হারে বায়ুদূষণ বাড়ে। শীতে আর্দ্রতা কম থাকায় এই সময়ে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণাগুলোর উপস্থিতিও বেড়ে যায়। তাই বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন করে এই দূষণ রোধ করা সম্ভব নয়। এর জন্য সচেতনতা এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা খুবই প্রয়োজন। দেশের বায়ুদূষণ যে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে, এ ব্যাপারে উদাসীনতা কাটাতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উদ্যোগ গ্রহণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের নিজেদের স্বার্থে এই ঢাকা শহরের বাতাস নির্মল রাখতে হবে, যেসব কারণে বায়ু দূষিত হচ্ছে, তা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করতে হবে। যেমন: পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমানো ব্যবস্থা করতে হবে বা কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সঠিক সমাধান বের করা, রান্নার কাজে উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা, এয়ার কন্ডিশনের ব্যবহার কম করা এবং প্রচুর বৃক্ষরোপণ করা ও প্রত্যেক ফাকা স্থানে বা বাড়ির ছাদে গাছ লাগানো বাধ্যতামূলক করা, নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করলে অথবা নির্মাণকাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, শুষ্ক মৌসুমে শহরগুলোয় দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছেটানোর ব্যবস্থা করা, রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা, অবৈধ ইট ভাঁটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো ও ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করাসহ সরকারি-বেসরকারি যেসব প্রকল্প বায়ু ও পরিবেশ দূষণের কারণ হয়ে উঠবে, সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে জবাবদিহি ও পরিবেশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তাহলে হয়তো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মল ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠবে। তাই আমাদের পরমায়ু বৃদ্ধির জন্য নির্মল বায়ু নিশ্চিত করা হোক। সূত্র : এফএনএস