বুধবা, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:৫৩ am
শিক্ষকদের উপর আকস্মিক হামলা, তাদের শারীরিকভাবে প্রহার করা এবং লাঞ্চিত করা এখন যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যেই শিক্ষককে পেটানোর খবর পড়তে হয়। যদিও এই ‘পেটানো’ শব্দটি শুনতে বেশ খারাপ লাগে কিন্তু সত্যি বলতে এটাই হচ্ছে এবং অধঃপতনের যে অবস্থা তাতে ভবিষ্যতেও হবে। শিক্ষকরা আজকাল যত্রতত্র পিটুনি খেয়ে অপমানিত হচ্ছেন! এতে জাতির সরাসরি কোনো ক্ষতি হচ্ছে না ঠিক কিন্তু যে ক্ষয় ধরেছে সেখান থেকে ফেরা প্রায় দুঃসাধ্য।
কারো কারো ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের পরিচয়ও থাকে। এই যে সমাজে বাজে নজির তারা তৈরি করছেন সেখান থেকে জাতিকে ভবিষ্যতে মুক্ত করতে পারবেন তো? আজ না হয় নিরীহ শিক্ষককে পেটালেন কিন্তু কাল আপনার-আমার সন্তান এখান থেকে কী শিখছেন সে খোঁজটাও রাখা জরুরি। যারা শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছেন না তারাও তো শিশুকালে কোনো না কোনো শিক্ষকের কাছেই শিখতে গিয়েছিলেন। আফসোস সেই শিক্ষকের জন্য যারা তাদের একদিনের জন্যও শিখিয়েছেন। তারা যদি জানতেন একদিন এই ছাত্র তারই মতো কোনো শিক্ষককে প্রকাশ্যে পেটাবেন তাহলে তাদের শিষ্য করতেন না।
এই তো মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে একজন প্রধান শিক্ষককে ও সহকারী শিক্ষককে পেটানোর ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকদের অভিভাবক পেটায়, ছাত্র পেটায়, নেতাকর্মীরা পেটায়। এই যেন শিক্ষকদের নিয়তি! মুখে অবশ্য সকলেই বলেন যে, শিক্ষকরা হলেন জাতির কর্ণধার, নির্মাতা, কারিগর ইত্যাদি আরও বড় বড় সব কথা! কিন্তু কাজের বেলায় খোলা কলসি। অন্য পেশার থেকে সবচেয়ে বেশি মার খেতে হয় শিক্ষকদের। এর কারণ বোধহয় তারা শিক্ষক, তাই। শিক্ষকরা চাইলেই রাস্তায় কাউকে গালি দিতে পারেন না, কারও সাথে মারামারি করতে পারেন না। কারণ তারা শিক্ষক। নিজেকে সেই পরিচয়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে হয়। তবে তারা যে মাঝেমধ্যেই এর ওর হাতে মার খাচ্ছে তার জন্য শাস্তিও হচ্ছে কিন্তু প্রবণতা কমছে না।
এটা মানছি যে শিক্ষকদেরও ভুল হয়, তারাও অন্যায় করতে পারেন কারণ তারও তো মানুষ। আর মানুষ মাত্রই ভুল হয়। এমন কোনো শ্রেণি পেশার মানুষ নেই যার ভুল হয় না। কিন্তু তাই বলে রাস্তায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীর সামনে মার খাওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়নি। অন্তত পত্রিকায় যা পাই তার বেশিরভাগই শিক্ষকদের নিয়ে। যদি একজন শিক্ষক অন্যায় করেন তবে তার জন্য শাস্তি হবে। কিন্তু সেটা কি পেটানো যায়? আইন তো আছে। সেই মতো ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তা না করে তাকে রাস্তাঘাটে পেটানো হচ্ছে।
এরচেয়ে একটি জাতির জন্য আর বড় লজ্জার আর কী হতে পারে! তারা যেন এটা না বোঝে যে শিক্ষককে পেটানো মানে নিজেদেরই নগ্ন করে সভ্য সমাজের সামনে উপস্থিত করা। নিজের চরিত্রকে বাইরে প্রকাশ করা। যদিও যারা এই পেটানোর কাজটি করেন তারা বেশ দাম্ভিকতায় থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবক একে অন্যের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে গাঁথা। সেখানে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং শিক্ষা প্রদানের সম্পর্ক বিদ্যমান থাকবে। এখানে নৈতিকতার শিক্ষা পাওয়ার সাথে সাথে তা চর্চাও হবে। কিন্তু ইদানিংকালে তা হচ্ছে কি? শিক্ষকদের ওপর থেকে শিক্ষার্থীদের সেই সম্মানবোধ, শ্রদ্ধা কমে গেছে। কোথাও কোথাও শিক্ষার্থীর হাতেই তার শিক্ষককে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে হচ্ছে আবার কোথাও শিক্ষার্থীর পক্ষ থেকে তাদের অভিভাবকরা শিক্ষককে আঘাত করছে, অপমান অপদস্থ করছে। শিক্ষকতা একটি পেশা।
অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবির সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সাথে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। কারণ শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সেই চ্যালেঞ্জ যেমন ছাত্রছাত্রীকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করার থাকে সেভাবেই থাকে তাদের বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনার। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটাই শিক্ষকতা।
কিছুকাল আগেই ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু হয়েছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের একটি ঘটনা পত্রিকায় দেখেছি। শ্যামনগরের গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কাশেমকে বেধড়ক মারপিট করে শিক্ষার্থীর অভিভাবক। তার মানে হলো সংস্কৃতিটা বদলে গেছে। এখানে বোধহীন মানুষগুলো বুঝে গেছে যে শিক্ষকদের পেটানো যায়! অনেক অভিভাবক নিজের সন্তানকে শাসন তো করেই না উল্টো শিক্ষকের বারোটা বাজানোর কাজেই ব্যস্ত থাকে। এই হলো ইদানিংয়ের প্রকৃত চিত্র।
শিক্ষার্থীকে মৃদু শাসন তো ভালো অনেক সময় কড়া ভাষায় কথা বললেও তাকে অভিযোগ শুনতে হয়! সুতরাং দেখা যায় যে নৈতিক অধঃপতন শুধু ছাত্রছাত্রীর ঘটছে না বরং তাদের অভিভাবকদেরও ঘটছে। পুরো দেশেই এই অধঃপতনে যাওয়া মানুষগুলো খুঁটি গেড়ে বসে আছে। মোট কথা একটি সামাজিক ব্যাধি ছড়িয়ে পরেছে। যার পেছনে আছে নিজের ক্ষমতা জাহির করার মিথ্যা অহংকার। পুরো সমাজব্যবস্থাই এই ধরনের ঘটনার জন্য দায়ী। এমন কোনো বাজে উদাহরণ সমাজে কারও তৈরি করা উচিত নয় যখন পুরো দেশই তার জন্য ভুগতে পারে। এমনকি কোথাও কোথাও শিক্ষক নিজেও এর জন্য দায়ী থাকেন। এই ঘটনা কেন ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব?
এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ঐ অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পঁচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখিনি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিল আজ তা নেই। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়েছে। যত সম্পর্ক ঢিলা হয়েছে তত শ্রদ্ধা, ভক্তি কমেছে। সেই বাদশা আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। আমরা ভুলেই যাই একজন শিক্ষককেও বাজার করতে হয়, তার সংসার-সন্তান আছে, তারও কাজ করতে গিয়ে কিছু ভুল হয়। তবে শিক্ষক কাউকে পেটান না শুধু অন্যের প্রহারের শিকার হতে হয় এই যা পার্থক্য!
শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। আমরা যদি এখনও ঘুরে না দাঁড়াই তাহলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীকে শাসন করতে যাবেন কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ শাসন মানেই সেই ছাত্রের বিরাগভাজন হতে হবে। আবার শুধু ছাত্রছাত্রী কেন অনেক অবিবেচক অভিভাবককেও দেখেছি তুচ্ছ কোনো কারণে তার সন্তানের হয়ে শিক্ষককে অপমান করতে ছাড়েন না। এ ক্ষেত্রে সেই ছাত্র আরও বেশি সাহস পায়। অবশ্য ছাত্রকে শাসন করা যদি অপরাধের ভেতর পরে তো অন্য কথা! একসময় মানে আমাদের সময় বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বলে আসতো- আমার সন্তানকে রেখে গেলাম। ওকে পড়ানোর প্রয়োজনে যা শাসনের দরকার হয় করবেন। এখন ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করা নিষেধ। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকরা বেত নিয়েই ক্লাসে যেতেন। পড়া না হওয়ার জন্য, দুষ্টুমির জন্য বেতের বাড়ি খেতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না বা এখনও নেই। আমি মনে করেছি এই শাসনের অধিকার কেবল আমার শিক্ষকদেরই ছিল। আর এখন সামান্য শাসনও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দেয়।
শিক্ষকতা কোনো পেশা নয় বরং এটি একটি ব্রত। সেই ব্রত পালন করতে গিয়েই এই দুরাবস্থার শিকার হতে হয়। দেশের মেধাসম্পদ তৈরি করার মূল কারিগর হলো শিক্ষক। তাদের রাস্তাঘাটে শারীরিক নির্যাতন করে সেই কারিগরদের অপমান-অপদস্থ করে দেশের ভালো কোনো উদাহরণ তৈরি করা হয় না। উল্টো সমাজটাকে পেছনের দিকেই ঠেলে দেয়। যেসব তথাকথিত মানুষ সে হোক কোনো শ্রেণিপেশার, ব্যবসায়ী অথবা রাজনীতিবিদ যিনি শিক্ষকের গায়ে হাত তুললেন তিনি গোটা দেশের গায়েই হাত দিলেন। তাকে পেটানোর মধ্যে কোনো বীরত্ব নেই। একদিন আপনার সন্তানই আপনাকে ঘৃণা করবে কেবল এই খারাপ কাজটির জন্য। শুধু সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক। সূত্র : এফএনএস