শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:০৭ am
বাংলাদেশে বেকারত্বের মিছিলে নতুন একটি সমস্যা উদ্বেগজনক বলে মনে হচ্ছে। সেটি হলো- তৈরি পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের নিয়োগ কমে যাওয়া। ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প মোট ৩ হাজার ৫০০টি রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনকারী কারখানার তথ্য সংগ্রহ করে দেখিয়েছে, যেখানে নারী শ্রমিকদের হার ৫৮ শতাংশ ও পুরুষ ৪২ শতাংশ। অথচ একটা সময় নারী শ্রমিক ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। করোনাকালে বাল্যবিবাহ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতিতে শহরে বসবাস কঠিন হয়ে পড়া, কারিগরি সমস্যা, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় নারীদের পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের অভাব ইত্যাদি কারণে পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিক কমছে। অন্যদিকে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগের হার বাড়ছে। প্রান্তিক অর্থনীতির এসব নারীদের কর্মহীন হয়ে পড়াটা দেশের অর্থনীতির জন্য সুখকর কোনো খবর নয়। দেশের বড় একটি অংশের উন্নয়নে এ সমস্যার সমাধান জরুরি।
বেসরকারি হিসাবে দেশে প্রায় ৬০ লাখ উচ্চশিক্ষিত বেকার রয়েছে। এ অবস্থাতেও দেশে নেই কর্ম তৈরির সরকারি কোনো কৌশল। নেই বেকারত্বের কেন্দ্রীয় ডাটাবেস ও চাকরি তৈরির মাসিক ড্যাশবোর্ড। ফলে সরকার ও পরিসংখ্যান ব্যুরো বেকারত্ব পরিস্থিতি নিয়ে অন্ধকারে রয়েছে।
সরকার দাবি করেছে, দেশের অর্থনীতি পোক্ত। মানুষের আয় বাড়ছে এবং মাথা তুলছে কর্মসংস্থানের হার। সরকারের এ দাবি যদি সত্য হয় তাহলে সরকারি অফিসে জনবলের পদ খালি থাকছে কেন? অতিসম্প্রতি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সংসদে জানিয়েছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও অফিসে বেসামরিক জনবলের ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য রয়েছে।
দুই.
সম্প্রতি বাংলাদেশ যুব ইউনিয়নের দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য দেশের বেকার যুবকদের সরকারের সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সর্বশেষ জনশুমারির তথ্যানুযায়ী দেশে এখন পাঁচ কোটি যুবক রয়েছে। এর মধ্যে গড়ে তিনজনের মধ্যে একজন বেকার। এ অবস্থায় বাংলাদেশে কর্মের নিশ্চয়তা দিয়ে একটি আইন প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।
দেবপ্রিয়র বক্তব্যের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত। একই সঙ্গে মনে করি, কর্মসংস্থান কমিশন গঠনও এখন জরুরি। ওই কমিশন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবে। দেশে যুবসমাজের ভেতরে নানা ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অনেকেই হতাশ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন। অনেকে আবার মাদকাসক্তসহ নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হচ্ছেন। কেউ কেউ উগ্রবাদী চিন্তার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এটি আমাদের জন্য বড় ধরনের অশুভ সংকেত। এসব থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হলে উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।
তিন.
সবচেয়ে বড় চাকরির বিজ্ঞাপনের সাইট বিডিজবস। তাদের তথ্যমতে, ২০২২ সালের আগস্টের পর তৈরি পোশাক খাতের কর্মসংস্থানে নেতিবাচক ধারা শুরু হয়েছে। কমেছে চাকরির বিজ্ঞপ্তি, শূন্যপদ এবং বিজ্ঞাপনদানকারী কোম্পানির সংখ্যাও। ২০২২ সালের শেষ চার মাসে পূর্ববর্তী বছরের একই সময়ের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞাপনের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। বিডিজবসে চাকরির বিজ্ঞাপন কমার হার পোশাক খাতের ক্রয়াদেশ কমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করা হচ্ছে।
টানা ১৩ মাস ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির পর গত সেপ্টেম্বরে দেশে রপ্তানি আয় কমে যায়। পাশাপাশি আছে বিদ্যুৎ, জ্বালানিসংকট, ডলারের উচ্চমূল্যে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হওয়া, এলসি বন্ধ ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সংকট। তবে সরকার সবকিছুই যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দার ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা সরকারের দিক থেকে দায় এড়ানোর একটি সুবিধাজনক কৌশল। সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার আশঙ্কা থাকলেও উন্নত বিশ্বে করপোরেট লভ্যাংশ উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার রেকর্ড পর্যায়ে কম। ফলে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতসহ সার্বিক বেকারত্ব পরিস্থিতির জন্য বৈশ্বিক সমস্যার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ডলার রিজার্ভ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা, ঋণপত্রসংকটও দায়ী বলে প্রতীয়মান হয়। রয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ মন্দা, সরকারের উচ্চ ঋণ ও খোলাবাজারে ডলার বিক্রয়জনিত তারল্যসংকট, প্রকৃত ব্যবসায়ীদের ঠকিয়ে ঋণখেলাপিদের একতরফা সুবিধাদানের কাঠামোগত সমস্যা।
বাংলাদেশের চাকরি বাজারে আগে থেকেই দক্ষ জনবলপ্রাপ্তির সমস্যা রয়েছে। বাজার চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার কোর্স-কারিকুলামের সংযোগ স্থাপিত হয়নি বলেই এক পদের বিপরীতে শত শত আবেদনকারী থাকেন, কিন্তু যোগ্য ও দক্ষ কর্মী পাওয়া যায় না।
চার.
তৈরি পোশাকশিল্পসহ প্রায় সব শিল্পই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও রূপান্তর-প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অটোমেশন বাড়ছে, নিম্ন দক্ষতার চাকরি কমছে। এমতাবস্থায় নতুন শিল্প চাহিদার ভিত্তিতে একাডেমি ও ইন্ডাস্ট্রির যৌথ সমন্বয়ে দ্রুত দক্ষ শ্রমিক তৈরির রোডম্যাপ বাস্তবায়ন করতে হবে। একটা নিরবচ্ছিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিক তৈরি করলে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি শ্রমিকপ্রতি মাথাপিছু রেমিট্যান্সও বাড়বে। বর্তমানে কারিগরিভাবে দক্ষদের চাকরি বাড়ছে, অদক্ষ কিংবা স্বল্প দক্ষদের চাকরি কমছে। দেশে ও দেশের বাইরে এই পরিস্থিতির সুবিধা নিচ্ছে বিদেশিরা। অভ্যন্তরীণ শিল্প, রপ্তানিমুখী শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিক- তিন ক্ষেত্রেই দক্ষতার চাহিদা প্রযোজ্য।
দেশের প্রায় ৮৫ থেকে ৮৯ শতাংশ শ্রমবাজার অপ্রাতিষ্ঠানিক। ফলে চাকরি বাড়াতে বেসরকারি খাতে সত্যিকার বিনিয়োগ বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ দরকার। সরকারকে ক্ষুদ্র, এসএমই, বৃহৎ ব্যবসা ও শিল্পের ভালো ব্যবসায়ীর ডাটাবেস তৈরি করতে হবে, যারা ঋণ নিয়ে কিস্তি ফেরত দেন ও ব্যবসা করেন। সেই তথ্যশালার আলোকে ক্রেডিট রেটিং-ভিত্তিক আধুনিক ঋণদান ব্যবস্থা দরকার। ব্যাংক ঋণদানের ক্ষেত্রে আর্থিক তথ্যনির্ভর নতুন ডিজিটাল কৌশল বের করাও জরুরি। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত এবং ক্ষুদ্র বা ব্যাস্টিক অর্থনীতির চাকরি বাঁচানো মন্দাকবলিত অর্থনীতির বড় কাজ। প্রশাসনের দুর্নীতি ও সরকারের অপখরচের লাগাম টেনে ধরে সামাজিক নিরাপত্তা ও চাকরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
বর্তমানে আমানত প্রবাহ কম ও তারল্যসংকট পরিস্থিতিতে ছয়-নয় সুদের হার কাজ করছে না। এর মূল কারণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা বিদেশে পাচার। দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে হলে এসব অনিয়ম বন্ধ করতে হবে। প্রকৃত ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা দিতে হবে এবং খেলাপি নয়, এমন ব্যবসা ও শিল্পমালিকদের সহজ শর্তের ঋণ দিতে হবে। অর্থাৎ বর্ধিত বেকারত্বের ধারা থামাতে মুদ্রানীতিকে কর্মসংস্থান তৈরির জন্য সহজ করতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জনসম্পদকে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আধুনিক অটোমেশন করা উৎপাদন পরিবেশের সঙ্গে তাল মেলাতে শ্রমিকদের দক্ষতা অর্জনে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা, ট্রেনিং বাজেট ও ট্রেনিং জরুরি।
পাঁচ.
বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে ধীরে ধীরে বিদেশি শ্রমিক কমিয়ে আনার ওপর জোর দেয়া প্রয়োজন। অবশ্যই নতুন কর্মদক্ষতার মানবসম্পদ বিদেশ থেকে আনতে হবে এবং সেখানেও দক্ষতা বিনিময়ের শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার মোট শ্রমবাজারের মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশের নিয়োগদাতা। বর্ধিত বেকারত্বের সমস্যার মুখে সরকারি শূন্যপদে নিয়োগের হার বৃদ্ধি করা দরকার। সেবা খাতে মাথাপিছু নিয়োগের কর্মসংস্থানবান্ধব বাজেটীয় কৌশল দরকার। মাথাপিছু শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা কর্মী নিয়োগ বাড়িয়ে সরকারি কর্মসংস্থানকে অন্তত ৫ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন। তবে মেধাভিত্তিক নিয়োগ না দেয়ায় প্রশাসন অদক্ষ ও অযোগ্য কর্মচারী-কর্মকর্তার ফাঁদে জড়িয়ে যাচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে।
চাকরির জন্য ভিড় বাড়ছে। কিন্তু চাকরি বাড়ছে না। যে অর্থনীতি আয়ের সুযোগ দিতে পারে না, তা কোনো অর্থে স্বস্তিদায়ক নয়। শিক্ষা শেষে কাজে যোগ দিতে না পারা মানে শিক্ষিত মানুষের কর্মক্ষমতার অপচয়। অবসরের গড়পড়তা বয়স ৬০ বছর। তাই চাকরি পেতে যত দেরি হবে, তত অপচয় হবে কর্মক্ষমতার। যা দেশের সব থেকে মূল্যবান সম্পদ। বেকারত্বের কারণে মানবসম্পদের অপচয় আখেরে সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই জনবহুল দেশের যুবসমাজকে শুধু চাকরির ওপর নির্ভর করে না থেকে স্বনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষাগত ডিগ্রি অর্জন নয়, হাতে-কলমে শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি।
লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন। সূত্র : দৈনিক বাংলা