শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০১:৩৬ pm
সড়ক ও নৌপথের চেয়ে আকাশপথের যাত্রা অনেকটা নিরাপদ মনে হলেও এ পথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাগুলো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক হয়। গত ১৫ জানুয়ারি নেপালের ইয়েতি এয়ারলাইনসের এটিআর-৭২-৫০০ উড়োজাহাজ পোখারা বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হয়েছে। নেপালের দ্বিতীয় জনবহুল শহর পোখারা দেশটির রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে ১২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। এটি হিমালয়ের প্রবেশদ্বার হিসেবেও খ্যাত। এই দুর্ঘটনায় জীবনের সব সম্ভাবনার সমাপ্তি ঘটেছে ৭২ জনের, যার মধ্যে ৬৮ জন যাত্রী, বাকি চারজন ক্রু। উড়োজাহাজটি স্থানীয় সময় সকাল ১০টা ৩৩ মিনিটে কাঠমান্ডু থেকে পোখারার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। আকাশে ওড়ার প্রায় ২০ মিনিটের মধ্যে এটি পোখারায় বিধ্বস্ত হয়।
এটি ছিল নেপালের তৃতীয় বৃহত্তম উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা। ১৯৯২ সালের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সংঘটিত অন্য দুটি দুর্ঘটনা ছিল থাই এয়ারওয়েজ ও পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের, যেখানে যথাক্রমে ১১৩ ও ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
সদ্য ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা সম্পর্কে বিবিসি থেকে জানা যায়, ১৫ জানুয়ারি ভোরে উড়োজাহাজটি অবতরণের আগ মুহূর্তে ল্যান্ডিং প্যাড পরিবর্তনের অনুমতি চাওয়ার পর শেষমেশ অনুমতি পেয়েও অবতরণ করতে পারেনি। তবে শেষ সময়ে এ ধরনের অনুমতি চাওয়ার কারণ নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, অবতরণের আগে মোড় নিয়ে কিছু বোঝার আগেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে উড়োজাহাজটি, এরপর অস্বাভাবিক রকম শব্দ করে নিচে নেমে গিয়ে গুরুং ঘারিপাতান এলাকায় একটি বাড়ির ছাদে বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত এলাকার জঙ্গলেও আগুন ধরে যায়। উড়োজাহাজটি ছেড়ে যাওয়ার ১৮ মিনিট পরে স্থানীয় সময় ভোর ১০টা ৫০ মিনিটে পোখারা বিমানবন্দরের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ ছিল বলে জানা যায়।
হিমালয়কন্যাখ্যাত দেশ নেপাল। এখানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্ঘসহ আটটি পাহাড় রয়েছে। পাহাড়-পর্বতঘেরা সুন্দর দেশটির প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির আকর্ষণে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক দেশটিতে বেড়াতে যান। ফলে নেপালের অর্থনীতিতে দেশটির পর্যটন খাত ও তাদের উড়োজাহাজ চলাচলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু শহরের কেন্দ্রের পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্রিভুবন। অবস্থানগত কারণে এই এয়ারপোর্টে বারবার উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটে বলে ধারণা প্রচলিত রয়েছে। বেশি দিন হয়নি, ২২ জন যাত্রী বহনকারী তারা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ ১৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ে বিধ্বস্ত হয়েছিল। ২০১৮ সালের ২৩ মার্চ ত্রিভুবনে অবতরণের আগ মুহূর্তে বাংলাদেশের বেসরকারি বিমান সংস্থা ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ ফ্লাইটে আগুন লেগে ৭১ জন যাত্রী প্রাণ হারান।
ত্রিভুবনের সেদিনের দুর্ঘটনা নিয়ে নানা বিতর্কে ইউএস-বাংলা বিমান কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয়েছিল যে ত্রিভুবন বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভুল বার্তাই ছিল দুর্ঘটনার কারণ। তারা পাইলটকে রানওয়েতে ল্যান্ডিংয়ের ব্যাপারে একেকবার একেক রকম নির্দেশনা দিয়ে বিভ্রান্ত করেছিল। অন্যদিকে ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ পাইলটের সিদ্ধান্তহীনতাকে দায়ী করেছে।
একটি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পরে অনুসন্ধানে তৎপর হয় বিভিন্ন সংস্থা। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সাধারণত এয়ারপোর্টের অবস্থান ও সেখানকার তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষমতা, উড়োজাহাজের ধরন ও প্রস্তুতকারী সংস্থার সক্ষমতা, চালকের দক্ষতা এবং উড়োজাহাজ চালনায় ভুলভ্রান্তি, দুর্ঘটনাকালীন আবহাওয়া বিবেচনায় নেয়া হয়। পর্বতের দেশ নেপালের আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তনশীল হওয়ার কারণে পাহাড় এলাকায় আকাশ থেকে দূরে স্পষ্ট কিছু দেখতে পাওয়া যায় না।
গত রোববার পোখারায় বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজ ছিল তুলনামূলক সস্তা মূল্যের টুইন প্রপ টার্বোজেট এটিআর মডেলের, যা এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চলাচলে বেশি ব্যবহৃত হয় বলে জানা যায়। উড়োজাহাজ তৈরিতে এই সংস্থার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। যদিও এর আগেও এ ধরনের উড়োজাহাজের একাধিক দুর্ঘটনার নজির রয়েছে বলে এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্য থেকে জানা যায়।
২০১৮ সালের ইউএস-বাংলা বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের ভুল বার্তা, উড়োজাহাজের পাইলটের সিদ্ধান্তহীনতার বাইরে আরও কিছু কারণ সামনে চলে আসে। পর্বতঘেরা ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চারদিকে প্রায়ই বৈরী আবহাওয়া থাকে। বরফাচ্ছন্ন পর্বত থেকে ভেসে আসে ধোঁয়ার মতো তুষারকণা। দুর্ঘটনার দিনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আর কানাডায় প্রস্তুতকৃত ইউএস-বাংলার ড্যাস-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজটি ছিল ১৭ বছরের পুরোনো। এর আগেও উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ৬৫-৭০ জন যাত্রী ধারণক্ষমতার এ উড়োজাহাজটি ১১ বার রানওয়েতে দ্রুত অবতরণ করতে বাধ্য হয়েছিল। যে কারণে প্রশ্ন জাগে, সামান্য ঝড়ো বাতাস সামলাতে না পারা এসব উড়োজাহাজ দিয়ে কীভাবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়?
পর্বতঘেরা বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ বিমানবন্দর নেপালের ত্রিভুবন। এই বিমানবন্দরের অবস্থান এবং মান নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। বিমানবন্দরটিতে এ পর্যন্ত ৭০টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। উড়োজাহাজের পাশাপাশি এ বিমানবন্দরে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালে ইউএস-বাংলার উড়োজাহাজের দুর্ঘটনার পর ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জরুরি ব্যবস্থাপনা ও সরঞ্জামের অভাবের কারণে বিমান দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজ ব্যাহত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ভাষ্য অনুযায়ী, উদ্ধারকর্মীরা যথাযথ সাজসরঞ্জাম পেলে বিধ্বস্ত উড়োজাহাজ থেকে অনেকের জীবন বাঁচানো যেত। কিন্তু সেটি তারা পায়নি। যে কারণে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। আরও একটি বিষয়, ঝুঁকিপূর্ণ এই এয়ারফিল্ডে ফ্লাইট অপারেশনের জন্য পাইলট ও ক্রুদের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সুতরাং এই বিমানবন্দরে যারা ফ্লাইট অপারেশন করে তাদের পাইলট ও ক্রুদের বিশেষ এই প্রশিক্ষণ আছে কি না, সেটি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে।
বিধ্বস্ত নেপালের ইয়েতি এয়ারলাইনসের এটিআর-৭২-৫০০ উড়োজাহাজ।
এবারের দুর্ঘটনায় ভস্মীভূত উড়োজাহাজের ‘ব্ল্যাক বক্স’ খুঁজে পাওয়া গেছে। ব্ল্যাক বক্সে ধারণকৃত পাইলট ও কন্ট্রোল টাওয়ারের কথোপকথন থেকে আগামীতে দুর্ঘটনার কিছু তথ্য মিলবে। ছয় মাস বা এক বছর পরে হোক, তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার কারণ জানা যাবে। আগামী দিনে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে হয়তো কিছু ব্যবস্থাও নেয়া হবে। কিন্তু ১৫ জানুয়ারির পোখারা বিমান দুর্ঘটনায় যে ৭২টি তরতাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেল তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। শেষ হবে না তাদের আত্মীয়স্বজনের কান্নাও। ২০১৮ সালের দুর্ঘটনার দিন ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে ১৩ জন শিক্ষার্থী ছিলেন, যারা নিজ দেশ নেপাল ছেড়ে সিলেটের একটি মেডিকেল কলেজে পড়তে এসেছিলেন। ছুটিতে দেশে গিয়ে আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেশার সুযোগ আর তারা পাননি। মৃত্যু তাদের কেড়ে নিয়েছে। আগামী দিনে বড় চিকিৎসক হয়ে দেশ ও দশের সেবায় আত্মনিয়োগের ইচ্ছেগুলো আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
ইউএস-বাংলার কো-পাইলট মৃথুলার মতো সম্ভাবনাময়ী নারীর পুরোদস্তুর পাইলট হয়ে আকাশ পাড়ি দেয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ পাইলট আবিদের মৃত্যুও অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাভিশন টিভির সেদিনের যুবক সাংবাদিক ফয়সল আর সংবাদ সংগ্রহে ছুটে বেড়াতে পারেননি শহরময়। উদ্যমী আলোকচিত্রী ফারুককেও আর দেখা গেল না ফটোগ্রাফারদের দলে। নেপালি নারী অঞ্জু ছিলেন কো-পাইলট, স্বপ্ন দেখেছিলেন আকাশ জয়ের, ১৫ জানুয়ারি পোখারায় প্লেনের ককপিটে তার দেহ পুড়ে অঙ্গার হয়েছে। তার মৃত্যুও কাঁদাবে অনেককে।
তবে নেপালে যা ঘটছে, সতর্ক হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা অবশ্যই কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য যেসব প্রতিষ্ঠান উড়োজাহাজ পরিচালনা করে তাদের মনে রাখতে হবে, নেপালের বিমানবন্দরগুলো দুর্ঘটনাপ্রবণ। এ বিষয়টি মাথায় রেখেই বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত পাইলট ও ক্রুদের ব্যবহার করতে হবে। নড়বড়ে, পুরোনো ও বৈরী আবহাওয়ায় কাবু হয়ে যেতে পারে এমন উড়োজাহাজ নেপালে না পাঠানোই ভালো। এ ক্ষেত্রে যেসব দেশে নেপালে ফ্লাইট পরিচালনা, সেসব দেশের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষেরও কিছু দায়িত্ব পালন করতে হবে। তা না হলে দুর্ঘটনা বারবার ঘটতেই থাকবে। লেখক : অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী, শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, সূত্র : দৈনিক বাংলা