শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:২৫ pm
মেট্রোর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ওয়াশিংটনে। প্রায় পঞ্চাশেও মাটির নিচে অন্য এক জগৎ আমাকে বিস্ময়াভিভূত করেছিল। সত্যি বলতে সেই বিস্ময়ের ঘোর আমার এখনও কাটেনি। ওয়াশিংটনের পর নিউ ইয়র্কেও মেট্রো চড়েছি। বাংলাদেশের মেট্রো আপাতত মাটির ওপরে। তবু আমার দেশে আমার মেট্রো, আমাকে আনন্দিত, আপ্লুত, বিস্মিত করেছে। বাংলাদেশে মেট্রোর উদ্বোধন প্রসঙ্গে বুয়েটের শিক্ষক ড. এম শামসুল হক বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মেট্রো বাংলাদেশের মানুষের নেশায় পরিণত হবে। তার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। কারণ, ওয়াশিংটনে প্রথম দেখা হলেও আমাকে মেট্রোর নেশা ধরিয়েছে দিল্লি মেট্রো। প্রথমবার দিল্লি গিয়েছিলাম বন্ধু কবি কবির হোসেন তাপসের সঙ্গে। সেবার দূর থেকে দেখলেও মেট্রো চড়া হয়নি। উবার আর সিএনজিতে দিল্লি ঘুরতে গিয়ে পকেটের দফারফা হয়ে গিয়েছিল।
সময়ের হিসাবও লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। পরেরবার দিল্লি গিয়েছিলাম স্ত্রী মুক্তিকে নিয়ে। সেবার বেশ কয়েক দিন থাকার পরিকল্পনা। অভিজাত মুক্তি সিএনজি বা বাসে চড়বে না। পুরো সময়টা উবারে চড়লে বাজেট ফেল হওয়ার ঝুঁকি। দিল্লি পৌঁছে আমি হোটেল থেকে মেট্রোর একটি ম্যাপ নিলাম। কিছুটা হোমওয়ার্ক করে ভয়ে ভয়ে মুক্তিকে বললাম, চলো একদিন মেট্রোতে চড়ি। কিছুটা অনিচ্ছায় সে রাজি হলো। কিন্তু চড়ার পর থেকে মেট্রো আমাদের নেশায় পরিণত হলো। তারপর থেকে যতবার দিল্লি গেছি, হোটেল নিয়েছি মেট্রোর কাছে এবং মেট্রো ছাড়া আমরা অন্য কোনও গণপরিবহন ব্যবহারই করিনি প্রায়। মেট্রো আমাদের সময় এবং অর্থ দুটোই বাঁচিয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা আমরা আনন্দের সঙ্গে ভ্রমণ করেছি।
দিল্লি মেট্রো জালের মতো ছড়ানো। ম্যাপটা ঠিকমতো জানা থাকলে, কোথায় চেঞ্জ করতে হবে বুঝলে মোটামুটি পুরো দিল্লি ঘোরা যায় মেট্রোতে। হোটেল থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালেও আমরা প্রতিদিন যাতায়াত করেছি নিশ্চিন্তে। কলকাতা মেট্রো দিল্লি মেট্রোর মতো ততটা বিস্তৃত নয়, তবু অনেক সাশ্রয়ী। ওয়াশিংটন নয়, নিউ ইয়র্ক নয়, দিল্লি নয়, কলকাতা নয়; এখন আমার শহরে, আমাদের মেট্রোর নেশা আমাকে টানছে। আপাতত ঢাকা মেট্রোর যেই রুট, তা আমার খুব কাজে লাগবে না। তবু মেট্রোর নেশায় বুঁদ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। সাধারণের চলাচলের প্রথম দিনেই যে ভিড় আর উচ্ছ্বাস দেখলাম, তাতে কিছুটা সংশয়ে পড়ে গেছি, তবু ইচ্ছা আছে কাল শুক্রবার ছুটির দিনে মেট্রো চড়ার।
মেট্রোরেল উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আজকে আমরা আরেকটি নতুন অহংকারের পালক বাংলাদেশের জনগণের মাথার মুকুটে সংযোজিত করলাম।’ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার দেওয়া এই অহংকারের পালক আমরা নতমস্তকে, কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করলাম। আমি একটু যোগ করতে চাই, আমাদের অহংকারের মুকুটের সর্বশেষ পালকটিই সবচেয়ে ঝলমলে।
গত একযুগে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে অনেক বিস্ময় উপহার দিয়েছেন। সাবমেরিন, স্যাটেলাইট, টানেল সবগুলোই নতুন যুগ। আর মেট্রোরেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থা নতুন যুগে পা রাখলো। আর এই নতুন যুগটিই আমাকে সবচেয়ে বেশি অভিভূত করেছে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের আত্মমর্যাদার প্রতীক হলেও নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট-বড় অনেক সেতু আছে। কর্ণফুলী নদীর নিচের টানেলও নতুন যুগের যাত্রা। তবে সেটি চট্টগ্রামে হওয়ায় জাতীয় পর্যায়ে তার প্রভাব কিছুটা কম। স্যাটেলাইট, সাবমেরিন গর্বের হলেও দৃশ্যমান নয়। সাধারণ মানুষ এর প্রভাবটা উপভোগ করতে পারছে না। কিন্তু মেট্রোরেল আমাদের একই সঙ্গে গর্বিত করবে এবং এর সুফল পাবে লাখো মানুষ। সত্যি বলতে মেট্রোরেল বদলে দিয়েছে ঢাকার স্কাইলাইন। আপাতত এমআরটি-৬ লাইনের আংশিক উদ্বোধন হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাকি ৫টি লাইনও পুরোপুরি চালু হলে ঢাকা সত্যি বদলে যাবে। আর মেট্রোর বৃহৎ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীও যুক্ত হবে অভিন্ন নেটওয়ার্কে। তখন বদলে যাবে বাংলাদেশ। সেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা জানি না, আপাতত আমি উত্তরা-আগারগাঁও রুটের ১১.৭৩ কিলোমিটারের মেট্রো নিয়েই উচ্ছ্বসিত। তবে এই উচ্ছ্বাস আমার একার নয়, বাংলাদেশের সবার। একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মেট্রোরেলে আনন্দিত। বললেন, ‘জীবনে এই প্রথম বাংলাদেশের কোনও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে চড়তে পারলাম।’
তবে উদ্বোধনের দিনে চড়ার আগে দূর থেকে দেখেই এক খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের অনুভূতিই বলে দেয় মেট্রো কতটা আমাদের, ‘নিজে একটা ঘর করতে পারলে যতটা খুশি হতাম, মেট্রোরেল দেখে আমার সেরকম আনন্দ হচ্ছে।’ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই আসলে এই গর্বের অংশীদার। কাওরানবাজারে আমার অফিসের পাশ দিয়েই গেছে মেট্রোর লাইন। গত ৫ বছর ধরে প্রতিদিন তিল তিল করে মেট্রোর গড়ে ওঠা দেখছি। মনে হচ্ছে আমিও এই মেট্রোর অংশীদার।
ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে আরও অনেক আগেই মেট্রোরেল ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত ছিল। নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে এতদিন হয়নি। শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশ হতে যাচ্ছে বিশ্বের ৫৭তম দেশ, ঢাকা হতে যাচ্ছে ১৭৯তম শহর, যেখানে গণপরিবহন ব্যবস্থায় মেট্রোরেল চলছে। ১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডনে শুরু হওয়া মেট্রো ব্যবস্থায় নবতম সংযোজন ঢাকা। আপাতত সীমিত পরিসরে উত্তরা-আগারগাঁও রুটের মেট্রো হয়তো জনগণের খুব বেশি কাজে লাগবে না। কারণ, এই রুটের বেশিরভাগটাই আবাসিক এলাকা। তবে আগামী ডিসেম্বরে উত্তরা-কমলাপুরের ২১.২৬ কিলোমিটারের রুটটি পুরোপুরি চালু হলে লাখো মানুষ তার সুফল পাবে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে ১২৯.৯০ কিলোমিটারের মোট ৬টি রুট চালু হলে ঢাকার প্রধান সমস্যা যানজটের একটা সমাধান হয়তো আসবে।
অচল ঢাকায় গতি আনবে মেট্রোরেলে। আর ঢাকায় গতি এলে তা সঞ্চারিত হবে অর্থনীতিতেও। পুরোপুরি চালু হলে মেট্রোরেলে প্রতিদিন সময় বাঁচবে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকার। অন্যান্য গাড়ি চলাচলের খরচ কমবে ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার। এসব হিসাব-নিকাশের বাইরেও বলা যায়, মেট্রো বদলে দেবে আমাদের গণপরিবহনের ধারণাকেই। ঢাকা মেট্রোর ভাড়া তুলনামূলক বেশি। নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ায় ভাড়াও বেশি রাখতে হয়েছে। তারপরও মেট্রোর ভাড়ায় এর খরচ উঠবে না। মেট্রো স্টেশন ঘিরে আয়ের নতুন উৎস খুঁজছে কর্তৃপক্ষ। যেহেতু বাড়তি ভাড়া দিয়েও খরচ উঠবে না, তাই মেট্রোর ভাড়া কমানোর দাবি করে রাখছি। সরকার তো আর ব্যবসায়ী নয়। সরাসরি টিকিট বেচে লাভের চিন্তা করলে তো হবে না। সামগ্রিকভাবে মেট্রোরেল অর্থনীতিতে যে চাঞ্চল্য আনবে বিবেচনায় নিতে হবে তাও। শুধু যানজটের হিসাব নয়, মেট্রোর রুট ঘিরে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল প্রসারের সম্ভাবনার লাভও তো আখেরে সরকারের ঘরেই যাবে। বাড়তি ভাড়া সত্ত্বেও আমি মনে মেট্রো আমাদের সময় বাঁচাবে, অর্থ বাঁচাবে। উত্তরা থেকে মতিঝিলের বাস ভাড়া হয়তো মেট্রোর চেয়ে কম। কিন্তু তাতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। চার ঘণ্টার পথ যখন আপনি ৪০ মিনিটে পেরিয়ে যাবেন, বাড়তি ভাড়াও আপনার গায়ে লাগবে না। আর মেট্রোর চাপে আমাদের অন্যান্য গণপরিবহন সেবাও আরও উন্নত হবে। বিদ্যুৎচালিত বলে মেট্রো পরিবেশবান্ধব। পুরো মেট্রো চালু হলে রাস্তায় ছোট গাড়ির চলাচলও কমে যাবে। তখন ঢাকার বাতাস আরও উন্নত হবে। সব মিলিয়ে মেট্রো নিয়ে যাবে আমাদের গতিশীল এক নতুন বাংলাদেশে।
ঢাকার স্কাইলাইন বদলে দেওয়া মেট্রো হয়ে উঠুক আমাদের গণপরিবহনের লাইফলাইন। আমাদের সবার গর্ব, সবার অহংকার। লেখক : হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।