মঙ্গবার, ১০ িসেম্র ২০২৪, সময় : ১১:৪১ pm
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ আজ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা গৌরবের এক অনন্য দিন। ৫০ বছর আগের এ দিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে গর্জে উঠেছিল উত্তাল জনসমুদ্র। লাখ লাখ মানুষের গগনবিদারী স্লোগানের উদ্দামতায় বসন্তের মাতাল হাওয়ায় সেদিন পত পত করে উড়ে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা। শপথের লক্ষ বজ মুষ্টি উত্থিত হয় আকাশে। ফাগুনের সূর্য তখনো মাথার উপর। অগ্নিঝরা সেই দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহতী কাব্যের কবি হয়ে এলেন বঙ্গবন্ধু। তার বজ্রকণ্ঠের নিনাদে বাংলার আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলো স্বাধীনতার ঘোষণা।
‘একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে/লক্ষ লক্ষ উন্মুক্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে/ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে/কখন আসবেন কবি?’/ …শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/…. কে রোধে তাঁহার বজ কণ্ঠ বাণী?/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।/ সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ অগ্নিঝরা একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণের মুহূর্তটি এভাবে কবিতায় মূর্ত করে তুলেছেন।
বঙ্গবন্ধু সেদিন শুধু স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই চুপ থাকেননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণই ছিল ৯ মাসব্যাপী বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ঘোষণা ও মূল ভিত্তি। সেদিন বেলা ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আরোহণ করেন। ফাগুনের সূর্য তখনও মাথার উপর। মঞ্চে আসার পর তিনি জনতার উদ্দেশে হাত নাড়েন। তখন পুরো রেসকোর্স ময়দান লাখ লাখ বাঙালির ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব-শেখ মুজিব’ স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে।
প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। বজ কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘… তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবায়ে রাখতে পারবা না। বাঙালি মরতে শিখেছে, তাদের কেউ দাবাতে পারবে না। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর এ তেজোদীপ্ত ভাষণে গর্জে ওঠে উত্তাল জনসমুদ্র। তিনি সেদিন জনতাকে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এ ঘোষণা মুক্তিকামী মানুষের কাছে লাল-সবুজ পতাকাকে মূর্তিমান করে তোলে। আর এ মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হয়। বঙ্গবন্ধু সেদিন ‘আমি যদি হুমুক দেবারও না পারি’ বলেও সাড়ে সাত কোটি বাঙালির উদ্দেশে স্বাধীনতার আহ্বান রেখে যান।
সেদিন সারা দেশ থেকে ছুটে আসা স্বাধীনতা-পাগল মানুষের ঢলে রেসকোর্স ময়দানের চতুর্দিকে জনবিস্ফোরণ ঘটে। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে নারী-পুরুষের স্রোতে তিলধারণের জায়গা ছিল না। বেলা ৩টায় রেসকোর্সে সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সকাল থেকে মানুষের সমুদ্রে রূপ নেয়। রাজধানী ঢাকার চতুর্দিকে ছিলেন ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। আকাশে উড়তে থাকে হানাদারদের জঙ্গিবিমান।
শহীদ জননী জাহানার ইমামের লেখা একাত্তরের দিনলিপি গ্রন্থে ৭ মার্চের বর্ণনায় আছে, ‘রেসকোর্স মাঠের জনসভায় লোক হয়েছিল প্রায় তিরিশ লাখের মতো। কত দূরদূরান্ত থেকে যে লোক এসেছিল মিছিল করে, লাঠি আর রড ঘাড়ে করে- তার আর লেখাজোখা নেই। টঙ্গী, জয়দেবপুর, ডেমরা- এসব জায়গা থেকে তো বটেই, ২৪ ঘণ্টা হাঁটা পথ পেরিয়ে ঘোড়াশাল থেকেও বিরাট মিছিল এসেছিল গামছায় চিড়ে-গুড় বেঁধে। অন্ধ ছেলেদের মিছিল করে মিটিংয়ে যাওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে গেলাম। বহু মহিলা, ছাত্রী মিছিল করে মাঠে গিয়েছিল শেখের বক্তৃতা শুনতে।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তিমূল, উজ্জ্বল প্রেরণাভূমি। কিন্তু ৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে বারবার ইতিহাসের বিকৃতি ঘটেছে। নতুন প্রজন্মের কাছে প্রকৃত ইতিহাস লুকিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধূলিস্যাৎ করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্মকে বিকশিত করার উদ্যোগ নেয়। বঙ্গবন্ধু, ৭ মার্চ ও মহান স্বাধীনতার প্রকৃত সত্য তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্বের স্মৃতি’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো।
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির জীবনে অত্যন্ত গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে এবং বাঙালি জাতির অনুপ্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে অফুরন্ত শক্তি ও সাহস জুগিয়ে আসছে। একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের দলিল’ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এমন একটি ভাষণ যা যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বেজে চলেছে। কিন্তু ভাষণটির আবেদন এতটুকু কমেনি। ৫০ বছর ধরে একই আবেদন নিয়ে টানা কোনো ভাষণ এভাবে শ্রবণের নজির বিশ্বের ইতিহাসে নেই। বরং যখনই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এ ঐতিহাসিক ভাষণটি শোনে তখনই তাদের মানসপটে ভেসে ওঠে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আন্দোলন-সংগ্রামের মুহূর্তগুলো, আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠে দেশপ্রেমের আদর্শে। দিনটি উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শুধু বাঙালির নয়, বিশ্বব্যাপী স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য প্রেরণার চিরন্তন উৎস হয়ে থাকবে। তিনি বলেন, ৭ মার্চ বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় দিন। ১৯৭১ সালের এ দিনে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বজ কণ্ঠে যে কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নিহিত ছিল বাঙালির মুক্তির ডাক।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষে ৭ মার্চ এবার ভিন্ন আঙ্গিকে পালিত হবে। এবার প্রথমবারের মতো জাতীয় দিবস হিসাবে ৭ মার্চ উদযাপন করা হবে। এ উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান এবং দেশব্যপী জেলা-উপজেলায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। শনিবার বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ জানান, সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে। কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেলা ৩টায় অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে ভার্চুয়ালি উপস্থিত থাকবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচি : ভোর সাড়ে ৬টায় বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় এবং দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল ৯টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। পরদিন সোমবার বেলা ৩টায় আওয়ামী লীগের ৭ মার্চের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (ভিডিও কনফারেন্সে)। এছাড়া আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে।
আগামী বছর আরও বড় পরিসরে আয়োজিত হবে জয় বাংলা কনসার্ট : ঐতিহাসিক এই দিনটিতে নিয়মিত ‘জয় বাংলা কনসার্ট’ আয়োজন করে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) প্রতিষ্ঠান ইয়াং বাংলা। চলতি বছর কনসার্টটি আয়োজন করা হচ্ছে না বৈশ্বিক মহামারির করোনার কারণে। কিন্তু আগামী বছর কনসার্টটি আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সিআরআইয়ের ট্রাস্টি রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক। চলতি বছর কনসার্টের আয়োজন না হলেও বিগত বছরগুলোতে আয়োজিত কনসার্টের চুম্বক অংশগুলো নিয়ে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান আয়োজন করবে ইয়াং বাংলা যা তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে সম্প্রচার করা হবে। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেজেও এই আয়োজন সম্প্রচার করা হবে। এ ছাড়াও এই কনসার্টে নিয়মিত পারফর্ম করা ব্যান্ডদলগুলোকে নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হবে। সূত্র : যুগান্তর। আজকের তানোর