রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:১৫ am
ডেস্ক রির্পোট : শ্রম নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ নিষ্পত্তিতে বা শ্রম সংক্রান্ত যেকোনো সমস্যা প্রতিকারে রয়েছে শ্রম আইন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর অধীনে যত অপরাধ রয়েছে, তার প্রত্যেকটির বিচারের জন্য শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করার বিধান রয়েছে। শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, সর্বনিম্ন মজুরির হার নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, কার্যকালে দুর্ঘটনাজনিত কারণে শ্রমিকের জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্প বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরীর অবস্থা ও পরিবেশ এবং শিক্ষাধীনতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সম্পর্কে এই আইনে বর্ণিত রয়েছে।
শ্রম আদালতের দেওয়ানী এবং ফৌজদারি উভয় ধরনের এখতিয়ার রয়েছে, সেহেতু এখন ভিকটিম যেভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হোক না কেন, ন্যায় বিচারের জন্য অবশ্যই শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবেন। এজন্যে দেশে একটি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল ও ১০টি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে আরও তিনটি শ্রম আদালত প্রতিষ্ঠার। তারপরও বেশকিছু জটিলতায় এসব আদালতে মামলার জট বাঁধতে শুরু করেছে। সূত্রমতে, শ্রম আদালতগুলোতে বিচারাধীন আছে ২৫ হাজার ৮১টি মামলা। যার মধ্যে শ্রম আপিল ট্যাইব্যুনালে ১ হাজার ৪২২, ঢাকায় প্রথম শ্রম আদালতে ৮ হাজার ১২৫, দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৭ হাজর ৪৬২, তৃতীয় শ্রম আদালতে ৪হাজার ৬৬৬। চট্টগ্রামর প্রথম শ্রম আদালতে ১ হাজার ৭২৮ ও দ্বিতীয় শ্রম আদালতে ৬৩৫টি মামলা।
খুলনার শ্রম আদালতে ১৭১, রাজশাহীর শ্রম আদালতে ১৬৮, রংপুর শ্রম আদালতে ৫৬, সিলেট শ্রম আদালতে ৬৯ এবং বরিশাল শ্রম আদালতে ৬৬টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঢাকায় অবস্থানরত ৩টি আদালতের মামলার সংখ্যাই ২০ হাজার ৫৭২টি এবং বাকি ৭টি শ্রম আদালত আর শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল মিলিয়ে মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৫০৯টি। আর শ্রম আদালতে মামলা জট শ্রম আদালতে মামলা জটের কারণ হিসেবে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. ফারুক ৭টি কারণ চিহ্নিত করেছেন।
এগুলো হলোÑ শ্রম আইনের জটিলতা, শ্রম আদালতের বিচারকগণের বদলিজনিত কারণ, শ্রম আদালতের সদস্য উপস্থিতি সংক্রান্ত, অধিক্ষেত্রজনিত জটিলতা, সহায়ক কর্মচারীদের অদক্ষতা, শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাব, শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের স্থান সংকট। শ্রম আদালতে মামলা জটের কারণ হিসেবে শ্রম আইনের জটিলতাকে দায়ী করা হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রবর্তিত শ্রম আইনে ২০০৬, ২০০৮, ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে বেশকিছু সংশোধনী আনা হলেও কার্যকর সংশোধনী এখনো আসেনি। গুরুত্বপূর্ণ এই আইনে শ্রম আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিলের সুযোগ না থাকায় সংক্ষুব্ধ পক্ষ হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়ের করে। এর ফলে শ্রম আদালতে শুরু হওয়া মামলা স্থবির হয়ে পড়ে।
উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়েরজনিত কারণে শুধুমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালেই স্থবির মামলার সংখ্যা ৩৫২। মামলা জটের আরেকটি কারণ হচ্ছে শ্রম আদালত এবং শ্রম ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগের দীর্ঘসূত্রিতা। প্রায় সময়ই বিচারক নিয়োগ, বদলি অথবা অবসরজনিত কারণে শ্রম আদালতের বিচারকের পদ শূন্য হয়। দেশের একমাত্র শ্রম আপিল ট্রাইবুন্যালের চেয়ারম্যান পদটি এক বছর বা দুই বছরের জন্য নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু পদটি শূন্য হওয়ার পর চার থেকে ৯ মাস পর্যন্ত সময় লাগে বিচারক নিয়োগে। যে কারণে মামলা জট আরও বাড়ে। মামলা জটের তৃতীয় কারণ শ্রম আদালতের বিচারকগণের বদলিজনিত কারণকে দায়ী করা হয়েছে। আইন অনুযায়ী শ্রম আদালতের বিচারকগণ প্রেষণে নিয়োগপ্রাপ্ত হন।
স্বাভাবিকভাবেই শ্রম আদালতের বিচারকার্য সম্পর্কে পুরোপুরি অভ্যস্ত হতে কিছুটা সময় লেগে যায়। অপরদিকে যখন একজন বিচারক শ্রম আদালত পরিচালনায় দক্ষতা প্রদর্শন শুরু করেন ঠিক তখনি স্বাভাবিক নিয়মেই অন্যত্র বদলি হয়ে যান। তার স্থলে শ্রম আদালত সম্পর্কে অনভিজ্ঞ একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার সৃষ্টি হয়। শ্রম আইনের বেশকিছু ধারার মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে মালিক এবং শ্রমিক পক্ষের প্রতিনিধির সমন্বয়ে আদালত গঠন করতে হয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় ধার্য তারিখে নির্দিষ্ট প্রতিনিধির অনুপস্থিতের কারণে মামলা নিষ্পত্তি করা যায় না।
এছাড়া, অধিক্ষেত্রজনিত কারণে বেশিরভাগ মামলাই হয় ঢাকার প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শ্রম আদালতে। ফলে একজন বিচারকের পক্ষে এত বিপুল পরিমাণ মামলার চাপ সামলানো কষ্টকর হয়। এতে বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে। মামলা জটের কারণ হিসেবে সহায়ক কর্মচারীদের অদক্ষতাকেও দায়ী করা হয়েছে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল এবং বিদ্যমান শ্রম আদালতের কর্মচারীদের কোনোরূপ পদোন্নতি এবং বদলির সুযোগ নেই। ফলে খুব বেশি যোগ্য এবং দক্ষ কর্মচারীরা ধীরে ধীরে উদ্যম হারিয়ে ফেলে। শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভাবকেও ট্রাইব্যুনালে মামলা জটের কারণ। শ্রম আদালতের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারায় অধস্তন শ্রম আদালতসমূহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব হচ্ছে না, ফলে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণেও মামলাজট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। দেশের শ্রম আদালত সমূহ এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত ভবনে অবস্থিত।
যে কারণে সহায়ক কর্মচারী, সুপরিসর এজলাস, আইনজীবী এবং পক্ষদ্বয়ের পর্যাপ্ত বসার স্থান এবং উপযুক্ত পরিবেশ নেই, যা বিচারকার্য দীর্ঘায়িত করছে। আইনজীবীরা বলছেন, শ্রম আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা ও জট সমস্যা থেকে উত্তরণ পেতে দ্রুততার সঙ্গে শ্রম আইনে কার্যকর সংশোধন আনতে হবে। শ্রম আইনে আদেশের সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করে শ্রম আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষকে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল করার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় বা আদেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন দায়েরের পরিবর্তে প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের মতো সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার বিধান প্রণয়ন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এতে করে ট্রাইব্যুনালে আপিলের সংখ্যা বাড়লেও মামলাজট কমবে। কেননা শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল স্বল্প সময়ে মামলা নিষ্পত্তি করে থাকে। একইসঙ্গে শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারকের পদ শূন্য হওয়ার পর দ্রুত শূন্যপদে বিচারক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন আইনজীবীরা। শ্রম আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে শ্রম আদালতে নিয়োজিত ছিলেন এমন বিচারকদেরকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন বলে তারা জানান।
শ্রম আদালতগুলোর জন্য উপযুক্ত বিচারিক পরিবেশের স্বার্থে মানসম্মত ভবনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এদিকে দেশের মামলা জটের বিষয়টি শ্রম আদালতেও চলে এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, মূলত দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তবেই শ্রমিকেরা মামলা করতে আসেন। এসব মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হলে মালিকপক্ষের সুবিধা হয়। শ্রমিকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই এসব আদালতের মামলা নিষ্পত্তি দ্রুততার সঙ্গে করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানান তিনি। সূত্র : এফএনএস