শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৫৬ pm
ডেস্ক রির্পোট : অগ্নিনির্বাপণকারীদের ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে পূর্ণ সক্ষমতার সর্বোচ্চ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কাজ করছে।
প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ-২০২২’ এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন। মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত মূল আয়োজনে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন সরকারপ্রধান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, সেবার ক্ষেত্র এবং কর্তব্যরতদের মর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। কারণ আগুন লাগলে বা কোনো দুর্ঘটনা বা ভূমিকম্প বা কোনো কিছু ঘটলে অথবা কোনো ভবন ধসে গেলে ফায়ার সার্ভিসই সবার আগে ছুটে যায়। এমনকি কোনো জাহাজ বা লঞ্চ যখন দুর্ঘটনায় পড়ে, তখনো এই ফায়ার সার্ভিসকেই আমরা পাই। তাই তাদের আরও যুগোপযোগী করা একান্ত প্রয়োজন।’
‘ফায়ার সার্ভিস সম্পূর্ণ সক্ষমতায় উচ্চ ক্ষমতার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যেন রূপান্তরিত হয় সেই ব্যবস্থাই আমরা নিয়েছি। প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা আমরা দিয়েছিলাম, তা এখন শেষ পর্যায়ে। যারা এই কাজে সম্পৃক্ত তারা যেন উন্নতমানের প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি পান সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমি প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছি’, যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কর্তব্যপালনকালে নিহত ৩০ জন ফায়ার কর্মীকে স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী তাদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার ভার্চুয়ালি ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ-২০২২’ এর উদ্বোধন করেন। ছবি: ফোকাস বাংলা
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও নিরাপত্তা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য দেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীতাকুণ্ডে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১৩ জন অগ্নিবীরের পরিবারসহ ৪৫ জন দমকল কর্মীর হাতে চারটি কাটাগরিতে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স পদক-২০২২ তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী বাহিনীর কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন এবং রাষ্ট্রীয় সালাম গ্রহণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সেবার সক্ষমতা বাড়াতে বিপুল পরিমাণ উন্নত, আধুনিক, প্রযুক্তি সুবিধা সম্বলিত বিশ্বমানের অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছি। সর্বশেষ আমরা বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চতার ৬৮ মিটারের লেডার সম্বলিত টিটিএল গাড়ি ফায়ার সার্ভিসের বহরে যোগ করেছি। ৬৮ মিটারের পাঁচটি গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া এ অর্থবছরেই ১১টি টার্নটেবল লেডার (টিটিএল) ক্রয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। দুটি রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং ভেহিক্যাল দেয়া হয়েছে। নদীপথে সক্ষমতা বাড়াতে ২৪টি রেসকিউ বোট ও ১০টি ফায়ার ফ্লোট কেনা হয়েছে।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘লিঙ্গ সমতা দূর করতে ‘ফায়ারম্যান’ পদের নাম ‘ফায়ার ফাইটার’ করা হয়েছে। পরিদর্শকের সংখ্যা ৫০ থেকে ২৬৮, ডুবুরির সংখ্যা ২৫ থেকে ৮৫, অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা ৫০ থেকে ১৯২, আগুন নেভানোর পানিবাহী গাড়ি ২২৭ থেকে ৬১৭ এবং ফায়ার পাম্প ৪৫০ থেকে এক হাজার ৫৪৬টিতে উন্নীত করা হয়েছে। আগে ফায়ার সার্ভিসের কেমিক্যাল টেন্ডার, ব্রিদিং টেন্ডার, ফোম টেন্ডার, হ্যাজমেট টেন্ডারের মত বিশেষ ধরনের কোনো গাড়ি ছিল না। আমরা এ ধরনের ৩৫টি বিশেষায়িত গাড়ি প্রদান করেছি। যুগের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একসময়ের অবহেলিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।’
‘তারা (ফায়ার ফাইটার) নিজেদের জীবনবাজি রেখে মানুষের কল্যাণ করেন, মানুষকে উদ্ধার করেন। একটি মহৎ কাজে তারা নিয়োজিত রয়েছেন। কাজেই ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি সদস্যই দুঃসময়ের বন্ধু হিসেবে মানুষের কাছে প্রতীয়মান। সেজন্য ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে আমরা বিদেশি সহায়তাও কাজে লাগিয়েছি’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
‘আরবান বিল্ডিং সেফটি’ প্রকল্পের আওতায় জাইকার অর্থায়নে ফায়ার সার্ভিসের জন্য বহুতলবিশিষ্ট সদর দপ্তর ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ফায়ার স্টেশন পুনর্র্নিমাণ ও রেট্রোফিটিং এবং উঁচু মইয়ের গাড়ি ও বিশেষ পানিবাহী গাড়ি সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া কোরিয়ান কো-অপারেশন এজেন্সির সহায়তায় সদর দপ্তরে একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যদের হাতে পদক তুলে দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ছবি: পিআইডি
তিনি বলেন, ‘সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি সরকার এ সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা বাড়াতেও কাজ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পূর্ণাঙ্গ রেশন ও ঝুঁঁকিভাতা দেয়া হয়েছে। অপারেশনাল কর্মীদের জন্য তিন রঙের মর্যাদাপূর্ণ কমব্যাট পোশাক প্রবর্তন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পদকের সংখ্যা ও সম্মানী বাড়ানো হয়েছে। উদ্ধার কাজের সুবিধার্থে জার্মানির তৈরি তিনটি জাম্বু কুশন হস্তান্তর করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টে আমরা ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছি। আরও ২০ কোটি টাকা এই ট্রাস্ট ফান্ডে অনুদান দেবো আমরা।’ ১০ বছরে ১৬ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত ১০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা এক লাখ ৯২ হাজার ৮৭টি অগ্নিদুর্ঘটনায় অংশ নিয়ে ১৬ হাজার ৩০৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। একই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা এক লাখ ২৯ হাজার ৭৯৯টি অ্যাম্বুলেন্স কলের মাধ্যমে এক লাখ ২৬ হাজার ৮৩৯ জন রোগী হাসপাতালে স্থানান্তর করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় লাখ ১৩ হাজার ৬১ জন শিক্ষার্থীকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের নয় লাখ ২৫ হাজার ২৪০ জন কর্মীকে দুই দিনব্যাপী অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়া ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ প্রতিরোধে হেলপিং ফোর্স হিসেবে তারা ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৪৪৯ জনকে তিন দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি জানি, সারা জীবন আগুন ও ধোঁয়ায় কাজ করতে হয় বিধায় এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই অবসর বয়সে নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ কারণে আমরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আজীবন রেশন দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের জনবল ৩০ হাজারে উন্নীত করার কাজও হাতে নেয়া হয়েছে।’
যে কোনো ঝুঁকি হ্রাস করা, মানুষের নিরাপত্তা দেয়া, সেই সঙ্গে উন্নয়নের কাজগুলো দ্রুত ও ত্বরান্বিত করা এবং মানসম্মত করাই সবার প্রচেষ্টা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এদেশের প্রতিটি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে বিনা পয়সায় ঘর তৈরি ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সরকারের লক্ষ্য একটি মানুষও ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না।’
‘আমরা সব ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়টা হলো আমাদের উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাসের অভিঘাত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশনের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এই মন্দা মোকাবিলায় এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে’, বলেন সরকারপ্রধান। রা/অ