রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৩৪ am
নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ৮ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনাবাদী জমি খুঁজে বের করে চাষাবাদের আওতায় আনার নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্টদের।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশ মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই প্রশাসনের। অনাবাদী জমি খুঁজে বের করা তো দূরের কথা, রাজশাহীতে ফসলি জমি নষ্ট করে আবার শুরু হয়েছে পুকুর কাটার ধুম। প্রশাসনে অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কৃষকরা।
অভিযোগ মতে, প্রশাসন খুবই দায়সারাভাবে অভিযান করছে। পুকুর খাদকদের সামান্য অর্থ জরিমানা করছেন। জরিমানার টাকা গুণে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আবার শুরু হচ্ছে খনন।
এলাকাবাসীর অভিযোগে আরও জানা গেছে, বর্ষা মৌসুম গত হতেই রাজশাহীজুড়ে আবার শুরু হয়েছে পুকুর কাটার কাজ। দুই-তিন ফসলি ও অপেক্ষাকৃত নিচু জমিগুলো পুকুর খাদকদের মূল টার্গেট। রাজশাহীর মধ্যে বাগমারার বিল এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের ধুম পড়েছে এবং তা চলছে গত এক মাস ধরে।
অভিযোগ পেয়ে প্রশাসন দায়সারা অভিযান পরিচালনা করছেন, তবে থামাতে পারছে না পুকুর খনন যজ্ঞ। প্রতি বছর রাজশাহীর বাগমারাসহ আশপাশের এলাকায় পুকুরের পেটে শত শত বিঘা ফসলি জমি চলে গেছে। ফলে চাষাবাদ হুমকির মুখে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১২ অক্টোবর বিকালে বাগমারা উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের রামরামা গ্রামের মাঠে ফসলি জমি কেটে পুকুর খননকালে এলাকাবাসীর অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এলাকায় অভিযান পরিচালনা করেন। জব্দ করেন খননকাজে ব্যবহৃত দুটি ভেকু মেশিন। ধরা হয় ভেকুর দুই চালককেও।
অভিযান দেখে পালিয়ে যায় পুকুর খননকারী এবাদুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান ও মিঠুন আলী। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাঈদা খানম ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ভেকুর দুই চালককে চার হাজার টাকা জরিমানা করেন। কিন্তু জরিমানার টাকা পরিশোধ করেই সন্ধ্যার পর আবার পুকুর খনন শুরু করে খাদক দল।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, বাগমারার রামরামা দেবদত্বপাড়া এলাকার যশোর বিলের তিন ফসলি ৭০ বিঘা জমিতে পুকুর কাটছেন এলাকার কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। গত ১১ নভেম্বর এলাকার জমি মালিক ৩৩ কৃষক পুকুর খনন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
অভিযোগে কৃষকরা বলেন, এসব জমি তিন ফসলি। প্রচুর ধানসহ অন্য ফসল ফলে। এখন প্রভাবশালীরা এসব জমিতে জোরপূর্বক পুকুর কাটছেন। ৭০ বিঘা জমিতে পুকুর কাটা হলে এলাকার শতাধিক কৃষক জমি হারাবেন। ফসল উৎপাদন ব্যাহত হবে।
গত ১২ নভেম্বর বিকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিযান পরিচালনা করে পুকুর খনন বন্ধ করেন। তবে প্রশাসনকে ম্যানেজ করে খাদকরা পুকুর খননের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকরা জানিয়েছেন, রাজশাহী অঞ্চলে আবাদি জমিতে পুকুর খননে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এর পরও রাজশাহীর পবা, মোহনপুর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকায় দেদারসে পুকুর কাটার কাজ চলছে। বর্ষা মৌসুম গত হতেই পুকুর খননের হিড়িক লেগেছে জেলাজুড়ে।
পবার মৌগাছির কৃষক মুরসালিন হোসেন বলেন, গত ৫ বছরে তার উপজেলার ৩ হাজার হেক্টরের বেশি ফসলি জমিতে অবৈধভাবে পুকুর কাটা হয়েছে। একই পরিস্থিতি পার্শ্ববর্তী মোহনপুর, বাগমারা ও দুর্গাপুর উপজেলার।
মোহনপুর উপজেলার দাউকান্দি গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ফসলি জমি উজাড় করে রাজশাহীতে যেভাবে পুকুর কাটা হচ্ছে, তাতে আগামীতে চাষাবাদের জন্য কোনো জমি আর অবশিষ্ট থাকবে না।
এদিকে পুকুর খনন বন্ধে স্পষ্টভাবে আইন থাকার পরও আইনের সঠিক প্রয়োগ না করার অভিযোগ উঠেছে প্রশাসনের বিরুদ্ধে।
জেলার দুর্গাপুর উপজেলার আলীপুর গ্রামের কৃষক মজিবুর রহমান প্রামাণিক বলেন, পুকুর খনন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। কারণ যারা পুকুর কাটছেন তাদের কাছে কয়েক হাজার টাকা জরিমানা তেমন বিশেষ কিছুই নয়। বরং পুকুর খননের যন্ত্রপাতি জব্দ করে রাখা হলে পুকুর খননে কিছুটা ভাটা পড়ত। কারণ রাতারাতি এসব ভেকু মেশিনসহ যন্ত্রপাতি সহজে সংগ্রহ করা সম্ভব হতো না।
বাগমারার বড়বিহানালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান মিলন জানান, কয়েক দিন আগে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশে তিনি এক গ্রামপুলিশ বাজারের সামনের বিলে পুকুর খনন বন্ধ করতে যান। এ সময় পুকুর খননকারী আকরাম হোসেন ও তার সহযোগী আমিনুল ওই গ্রামপুলিশকে পিটিয়ে আহত করে। বিষয়টি তাৎক্ষণিক উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানালে তিনি থানায় অভিযোগ দিতে বলেন। কিন্তু প্রশাসন তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। পুলিশও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
এ বিষয়ে বাগমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইদা খানম জানান, উপজেলায় অবৈধ পুকুর খনন করার কোনো সুযোগ নেই। অভিযোগ পেলেই অভিযান ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসনের উদাসীনতার অভিযোগ সঠিক নয়।
এদিকে এলাকাবাসীর অভিযোগ পুকুর খননকারীরা কাজ শুরুর আগে প্রশাসন ও পুলিশসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করেন। এসব ক্ষেত্রে বিপুল টাকার লেনদেনেরও অভিযোগ রয়েছে। ফলে এলাকাবাসীর চাপে প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করলেও বাস্তবে কোনো ফল হচ্ছে না। প্রশাসনের সঙ্গে ইঁদুর-বিড়াল খেলে প্রভাবশালীরা ঠিকই পুকুর কেটে ফেলছেন। রা/অ