শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৪৩ pm
প্রশাসন নিয়ে সম্প্রতি যুগান্তরে দুটি রিপোর্ট এবং একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৮ অক্টোবর প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘সচিবের বাধ্যতামূলক অবসরে প্রশাসনে তোলপাড়’। পরদিন ১৯ অক্টোবর ‘প্রশাসনে শুদ্ধি অভিযান আর কতদূর’ শিরোনামে আরও একটি তথ্যবহুল সংবাদ। সর্বশেষ ২৩ অক্টোবর একটি মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম ছিল-‘অতিমাত্রায় ভেজালে ভরা প্রশাসন’। এই তিনটি প্রতিবেদনের বিষয়ে সরকারের মন্ত্রিসভার একজন দায়িত্বশীল সদস্য প্রতিবেদকের কাছে আরও বিস্তারিত বস্তুনিষ্ঠ তথ্য জানতে চান। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘যুগান্তরে প্রকাশিত উল্লিখিত তিনটি প্রতিবেদন প্রশাসনসহ অনেককে আরও সচেতন করেছে। আমি দেশের বাইরে থাকলেও খবরগুলো পড়েছি।
জেনেছি, আপনি দীর্ঘদিন প্রশাসনবিষয়ক সংবাদ করছেন। আপনার কাছে আরও ইনডেপথ তথ্য থাকতে পারে। সেগুলো নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সত্য সংবাদ লিখতে পারেন, যা সরকার এবং দেশের জন্য যেন কল্যাণ বয়ে আনে।’
একপর্যায়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘আসলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করতে বঙ্গবন্ধুর কথা অনেকে মুখে বেশি বেশি বলেন। কিন্তু অন্তরে তার নির্দেশনা ধারণ করেন না। আজকাল এ সংখ্যাটা অনেক। চারদিকে সব খন্দকার মোশতাকের দল। যাদের অনেকে বিভিন্ন স্থানে কৌশলে ঢুকে পড়ে আমাদের সরকারের ক্ষতি করার অপচেষ্টা করছেন। এছাড়া দেশ ও সরকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র তো হচ্ছেই। তবে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আল্লাহর রহমতে শক্ত হাতে সাহসের সঙ্গে সবকিছু মোকাবিলা করে যাচ্ছেন। তার দূরদর্শিতার ফলে আমরা করোনা পরিস্থিতি অনেক দেশের তুলনায় ভালোভাবে ফেস করতে পেরেছি। কিন্তু এখন আবার শুরু হয়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। অনাকাঙ্ক্ষিত এই যুদ্ধ বাংলাদেশ ছাড়াও পৃথিবীর বহুদেশকে ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে। তবে এটাও সত্য, সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। এজন্য দেশের স্বার্থে সৎ নিয়তে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। বিশেষ করে গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করাসহ যৌক্তিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে মনোনিবেশ করতে হবে।’
বৃহস্পতিবার রাতে মন্ত্রিসভার এ সদস্যের সঙ্গে রাজধানীর বেইলি রোডে তার মিনিস্টার্স অ্যাপার্টমেন্ট বাসভবনে একান্তে কথা হয় প্রতিবেদকের। হঠাৎ করে রাতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়। এ সময় তিনি সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনসংক্রান্ত যুগান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করা ছাড়াও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। বৈঠকটি অনানুষ্ঠানিক এবং অব দ্য রেকর্ড হওয়ায় মন্ত্রিসভার এই সুশিক্ষিত, মার্জিত, বেশ করিতকর্মা ইমেজসম্পন্ন সদস্যের নাম প্রকাশ করা হলো না।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যেদিন ভোরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সেদিন বিকালেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী। এমনকি ওই শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় চার নেতা ছাড়া মন্ত্রিসভার প্রত্যেকে যোগ দেন, যা ছিল জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যজনক।
এদিকে মতবিনিময়কালে প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার মন্ত্রিসভার এই সদস্য প্রতিবেদককে জানান, সরকার আসলে অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছে দেশটাকে উন্নতির কাঙ্ক্ষিত সোপানে নিয়ে যেতে। কিন্তু করোনা মহামারি এবং চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মতো পরপর দুটি বিপর্যয় বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অগ্রগতির ধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
মন্ত্রিসভার ইয়াং এই ডায়নামিক সদস্যের জানার আগ্রহ থেকে প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে প্রথমত জানানো হয়, যুগান্তর অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী আপসহীন একটি পত্রিকা। তবে পত্রিকাটির নিরপেক্ষ অবস্থানের শক্ত নীতির কারণে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরের সাহসী রিপোর্ট প্রকাশিত হয়ে থাকে। কাউকে ক্ষমতায় নিয়ে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করা কিংবা কাউকে ক্ষমতায় ধরে রাখার জন্য সংবাদ প্রকাশের নীতি পত্রিকাটির কখনো ছিল না এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না। যুগান্তর গণমানুষের পত্রিকা, সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলেই যাবে। নির্ভীকভাবে সব সময় সাহসের সঙ্গে সত্যটাই বলবে। এটিই পত্রিকাটির স্বপ্নদ্রষ্টা যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলামের নীতি এবং স্বপ্ন ছিল। তার রেখে যাওয়া ওই অবস্থান থেকে পত্রিকাটি কখনো সরে আসবে না। এ সময় অবশ্য প্রতিমন্ত্রী যুগান্তরের সত্য ও সাহসী রিপোর্টের ভূয়সী প্রশংসাও করেন। আলোচনা হয় প্রশাসনের সদর-অন্দরের জানা-অজানা আরও অনেক বিষয়ে। যুক্তি ও তথ্যনির্ভর ধারণাগত তথ্যের নানা বিশ্লেষণও ছিল খুবই চমৎকার। এভাবে ৩০ মিনিটের মতবিনিময় বৈঠকটি বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
আলাপকালে মন্ত্রিসভার এই সদস্য একমত পোষণ করে বলেন, ‘এটা সত্য যে একশ্রেণির ব্যক্তি ‘আমাদের লোক’ বলে তাদের নিজস্ব লোকদের প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্থানে পুনর্বাসন করতে সক্ষম হয়েছে। এখনো হয়তো সে অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। তবে আমাদের সরকার এসব বিষয়ে আরও সজাগ ও সচেতন।
প্রতিমন্ত্রীর প্রশ্নের জবাবে প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, আসলে ক্ষমতায় এসে যে কোনো সরকারের উচিত হবে, তিনি কী ধরনের ব্যুরোক্রেসি চান, সবার আগে সেটি নির্ধারণ করা। শতভাগ প্রফেশনাল, না কিছু বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য পলিটিক্যাল ব্যুরোক্রেটদের সঙ্গে বেশির ভাগ প্রফেশনাল ব্যুরোক্রেসির মেলবন্ধন। গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে প্রশাসনে দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে এটি বড় একটি চিন্তা ও সিদ্ধান্তের জায়গা বলে মনে হয়। শুরুতে এখানে ভুল হয়ে গেলে পরে বাগে আনা কঠিনের চেয়ে কঠিন হয়। প্রতিমন্ত্রীকে বলা হয়, আমার পর্যবেক্ষণে স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষ করে সংসদীয় সরকারের গণতান্ত্রিক নতুন অভিযাত্রা শুরুর পর ক্ষমতায় আসা সরকারগুলো এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে কি না, সেটিই এখন বড় একটি প্রশ্ন। যে কারণে প্রশাসনসহ সর্বক্ষেত্রে দলবাজি ও দলাদলির একটা অপসংস্কৃতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। পেশাজীবীদের অনেকে বুদ্ধিজীবী হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের পেশিশক্তিতে পরিণত করেছেন। এর ফলে রাতারাতি রং ও ভোল পালটানো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যার সারিও দীর্ঘ হয়েছে। যদিও সংবিধানে ‘কর্মকর্তা’ বলে কোনো শব্দ নেই। বলা আছে কর্মচারী।’
এদিকে সুবিধাবাদী কর্মকর্তাদের বেশির ভাগ ব্যক্তিস্বার্থে দ্রুত পদোন্নতিসহ প্রাইজ পোস্টিং নিতে মরিয়া। বিশেষ করে ‘পাওয়ার হাউজগুলোয়’ একধরনের অদৃশ্য নিজস্ব বলয় তৈরি করতে তারা অনেকে সক্ষম হন। এর ফলে প্রকৃতপক্ষে পেশাদার, মেধাবী এবং ক্ষেত্রবিশেষে যারা সরকারের প্রতি আনুগত্যের পরীক্ষায় পারিবারিক ও শিক্ষাজীবন থেকে পরীক্ষিত, তাদের পথকে রুদ্ধ করে দেওয়া সহজ হয়। যদিও সুশাসনের জন্য এমন মিস কন্ডাক্ট নীতিকে সমর্থন করার কোনো সুযোগও নেই। কিন্তু প্রশাসনসহ সমাজের সব ক্ষেত্রে একধরনের হাইব্রিড চাটুকার ও ক্ষমতাধরদের জয়জয়কার প্রতিষ্ঠিত হতে বেশি সময় লাগেনি। এর ফলে এ চক্রের খপ্পরে পড়ে কার্যত একদিকে দলীয় সরকার এবং অপরদিকে দেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই এসব দুষ্টচক্রকে চিহ্নিত ও প্রতিহত করা অনেক আগেই দরকার ছিল বলে সংশ্লিষ্টদের অনেকে মনে করেন। এদের বেশির ভাগ সমানে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেরা মোটাতাজা হয়েছেন এবং নানা সূত্রের দেওয়া বিশ্বাসযোগ্য তথ্য এবং অভিযোগ মতে, এরা শুরু থেকেই সুকৌশলে দুর্নীতি করেছেন এবং সেসব দুর্নীতির অর্থ বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে পাচারও করেছেন। ফলে সরকারের দায়িত্বশীল নীতিনির্ধারক মহল যদি মনে করেন, এসব পাবলিক পারসেপশনে কিছুটা হলেও সত্যতা আছে, তাহলে কালবিলম্ব না করে এ বিষয়ে নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও শক্তিশালী তদন্ত করা জরুরি। এদের মধ্যে যারা তাদের সন্তানদের বিদেশে লেখাপড়ার অজুহাতে পরিবারসহ গোপনে নিজের নাগরিকত্বও নিয়েছেন, তাদের বিষয়েও জোরালো তদন্ত হতে হবে। এখন তো ডিজিটাল গ্লোবাল ভিলেজ। এক বিশ্ব, এক গ্রাম। বিশ্বের এক প্রান্তের সচিত্র খবর বা তথ্য অপর প্রান্তে পৌঁছাতে কয়েক সেকেন্ড লাগে। অতএব তদন্ত করে অর্থ পাচারকারী দুর্নীতিবাজদের মুখোশ খুলে দেওয়া কঠিন কিছু হবে না। কারা সরকারের ইমেজ নষ্ট করে সমানে দুর্নীতি করেছেন এবং দেশে ও বিদেশে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় করেছেন, তাদের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা দেশের সাধারণ মানুষের এক নম্বর দাবি। আর শক্ত হাতে এটা করতে পারলে আখেরে সরকার এবং দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে। সরকারও প্রকৃতপক্ষে তার শত্রু ও মিত্র চিহ্নিত করার সরল পথ খুঁজে পাবে।
আরও কয়েকটি বিষয়ে ত্বরিত সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এর মধ্যে প্রথমত, কোনো অবস্থায় সরকারি চাকুরেদের রাজনীতির ধারেকাছে ভিড়তে না দেওয়া। এটা সরাসরি মিস কন্ডাক্ট বা অসদাচরণ। এ বিষয়ে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯তে সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া আছে। রাজনীতি করবেন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু যারা সরকারি চাকরিতে ঢুকে বিভিন্ন ফরমেটে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে রাজনীতি করে ফায়দা নিতে চান, তাদের জন্য তো আগেই রাজনীতি করার পথ খোলা ছিল। এতই যখন রাজনীতি করার শখ, তাহলে সরকারি চাকরিতে না এসে তারা বরং পছন্দের কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারতেন। কারণ, যখন কোনো রাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীরা রাজনীতি করেন, বা রাজনীতির সাইনবোর্ড ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশাসনে দলাদলি করে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন শুধু সরকার ও রাজনীতি দুর্বল হয় না, দেশের গণতন্ত্রও দুর্বল হয়। তাই সুশাসন নিশ্চিত করতে হলে যার যার নিজস্ব কক্ষপথে তাকে নিয়ম ও শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আইন ও বিধিবিধান বাস্তবায়ন করবেন সেবার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে; তারা শাসক না হয়ে সেবক হবেন-এটাই সবার প্রত্যাশা।
এছাড়া প্রায় দেখা যায়, অনেকে চাকরি থেকে অবসর নিয়েই বড় কোনো বেসরকারি কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যান। কিন্তু অভিযোগ আছে, এ ধরনের আমলারা চাকরিতে থাকাবস্থায় বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কারণে তারা এমন রাজসিক চাকরিটা আগে থেকে একরকম পাকাপোক্ত করে রাখেন। অপরদিকে, কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাবস্থায় নিজের পরিবারের লোকজনকে বিভিন্ন প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ পদে পুনর্বাসন করেন। সংশ্লিষ্ট পদের বিপরীতে মেধা-যোগ্যতার ভিত্তিতে যে কারও চাকরি হতেই পারে এবং নাগরিক হিসাবে তার সে অধিকারও আছে। কিন্তু ক্ষমতার বিশেষ তদবিরে ‘বিশেষ চাকরি’ পাওয়াটা অবশ্যই অন্যায়। এর বাইরে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকাবস্থায় রাজনীতি করার খায়েশ। এমন নজির প্রশাসনে ভূরিভূরি। এসব নিয়ে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে আমলাদের বহুবার নানা অঘটনও ঘটেছে। সংসদ-সদস্য হওয়া দোষের কিছু নয়। যোগ্যতা থাকলে এবং জনগণ ভোট দিলে যে কেউ নিয়মের মধ্যে প্রার্থী হতেই পারেন। কিন্তু সরকারি চাকরির বিশেষ পদ ব্যবহার করে আগে থেকেই এমপি-মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া এবং দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা কখনো কাম্য হতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাসযোগ্য ন্যায়বিচারভিত্তিক পদ্ধতি সংস্কার করা, যেখানে সিস্টেম থেকে ম্যানকে সম্পূর্ণ আলাদা করা সম্ভব। অর্থাৎ এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে কেউ যেন কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতে না পারেন। এছাড়া চাকরিতে মেধা কোটার শতকরা রেশিও আরও বাড়াতে হবে।
তৃতীয়ত, মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোয় ইনহাউজ প্রসিকিউশন ব্যবস্থা তথা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগের প্রাথমিক তদন্ত, বিভাগীয় মামলা দায়ের, প্রথম ও দ্বিতীয় শোকজসহ প্রতিটি ধাপকে শক্তিশালী ও প্রভাবমুক্ত করতে হবে। কেননা তদন্ত প্রক্রিয়ার ধাপে ধাপে অনেক ত্রুটি স্পষ্ট। যে কারণে অনেকে চাইলেও স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারেন না। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কিংবা বিভিন্ন প্রভাবশালী মহল থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে রক্ষা করার তদবির করা হয়। এছাড়া অনেক সময় রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি হিসাবে এমন একজনকে দেওয়া হয়, যিনি কৌশলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার পক্ষে অবস্থান নেন। আরেকটি হলো-তদন্তে দীর্ঘসূত্রতা, ঘনঘন রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিনিধি পরিবর্তন প্রভৃতি। তদন্তসংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করে এ বিষয়ে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর অভিযোগ পাওয়া গেছে, যা লিখলে তাদের চাকরি আর পদোন্নতি নিয়ে টান পড়বে।
যাই হোক, অভিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা তদন্তের শুনানিতে অংশগ্রহণ ছাড়া মামলা থেকে রেহাই পেতে কোনো তদবির করলে তাকে পালটা শাস্তি পেতে হবে-এমন বিধান রেখে আদেশ জারি করাও জরুরি। সব বাধা পেরিয়ে কখনো কারও বিরুদ্ধে গুরুদণ্ডের শাস্তি হলে সেবিষয়ে আবার ভেটিং কিংবা মতামত নেওয়ার জন্য পিএসসিতে (পাবলিক সার্ভিস কমিশন) নথি পাঠাতে হয়। অভিযোগ আছে, সেখানেও ক্ষমতার ভূত আসর করে। যাতে গুরুদণ্ডের শাস্তি না হয়, সেজন্য সব চেষ্টাই করা হয়। আর যদি ভিকটিম সরকারি চাকরিজীবী না হয়ে বাইরের কোনো সাধারণ ব্যক্তি হন, তাহলে তো কথাই নেই। এসব ক্ষেত্রে অনেক ঘটনা মাঠেই মারা পড়ে বা শেষ হয়ে যায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কিংবা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছায় না। এরপরও সাত ঘাটের পানি খেয়ে যেগুলো পৌঁছাতে পারে, তা নিয়ে হয়রানি-নাজেহালের সাতসতেরো চলতেই থাকে। ভাগ্য ভালো হলে যদি শক্ত আপসহীন কর্মকর্তার ওপর বিভাগীয় মামলার তদন্ত ভার পড়ে, তাহলে ২/১টা যে শাস্তি হয় না, তা নয়।
তবে পর্যবেক্ষক মহলের অনেকে মনে করেন, প্রতিটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে ক্যাডারভিত্তিক পৃথক বিশেষায়িত বিভাগীয় প্রসিকিউশনব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। সেখানে বাছাই করে এমন কর্মকর্তাদের পোস্টিং কিংবা তদন্তের দায়িত্ব দিতে হবে, কেউই যেন তাদের কোনোভাবে দমাতে না পারে। আর তা না হলে সবই ‘বজ আঁটুনি ফসকাগেরোতে’ পরিণত হবে। এছাড়া যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নৈতিকস্খলনজনিত অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের চাকরি থেকে বিদায় করে দিতে হবে। কেননা তারা চাকরিতে বহাল থাকলে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের সুনাম আরও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে। আর যদি এভাবে কঠোর ব্যবস্থা নিতে আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে মাঠ প্রশাসনসহ সর্বত্র কর্মকর্তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়তেই থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ঘটনায় সেটি আরও স্পষ্ট হয়েছে। গুরুদণ্ডের মতো শাস্তির অপরাধে তিরস্কার দেওয়ায় ভুক্তভোগীরা চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। এছাড়া সব ঘটনা তো সামনে আসে না। ঘটনাচক্রে এই ডিজিটাল যুগে ২/১টি ঘটনা গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যদি ভাইরাল হয়, তখন আমাদের টনক নড়ে।
সব শেষে প্রতিমন্ত্রীকে সুপারিশ আকারে বলা হয়, সচিবালয়ের মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণ শোনানো হলেও যেসব ভাষণ ও বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে কঠোর বার্তা দিয়েছেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন কঠোর হুঁশিয়ারি, সেগুলো দেখানো বা শোনানো হয় না। তাই যারা স্বার্থ হাসিলের জন্য বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলা বলতে বলতে অজ্ঞানপ্রায়, তাদের অফিসে যোগ দেওয়ার আগে প্রতিদিন একবার করে হলেও বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ ভাষণগুলো বেশি করে শোনা উচিত।
বঙ্গবন্ধুর আরও একটি দুর্লভ ভাষণ : ‘তোমরা আদর্শবান হও, সৎপথে থেকো। মনে রেখ, মুখে হাসি বুকে বল, তেজভরা মন, মানুষ হইতে হবে, মানুষ যখন। মাঝে মাঝে আমরা অমানুষ হয়ে যাই। এত রক্ত দেওয়ার পরও যে স্বাধীনতা এনেছি, পবিত্র এ পরিবর্তন অনেকের হয় না। এখনো ঘুসখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবারি, মুনাফাখোরি বাংলার দুঃখী মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত এদের আমি অনুরোধ করেছি, আবেদন করেছি, হুমকি দিয়েছি। চোররা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি।
কিন্তু আর না। বাংলার মানুষের জন্য জীবনের যৌবন আমি কারাগারে কাটিয়ে দিয়েছি। এ মানুষের দুঃখ দেখলে আমি পাগল হয়ে যাই। কাল যখন আমি আসতেছিলাম ঢাকা থেকে-এত দুঃখের মধ্যে না খেয়ে কষ্ট পেয়েছে, গায়ে কাপড় নাই, কত অসুবিধার মধ্যে তারা বাস করতেছে। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ লোক দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে আমাকে দেখার জন্য।
আমি মাঝে মাঝে প্রশ্ন করি-তোমরা আমাকে এত ভালোবাস কেন? কিন্তু যেই দুঃখী মানুষ দিনভরে পরিশ্রম করে, তাদের গায়ে কাপড় নাই, যাদের পেটে খাবার নাই, তাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত নাই। লক্ষ লক্ষ বেকার। পাকিস্তানিরা সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে। কাগজ ছাড়া আমার জন্য কিছু রেখে যায় নাই। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আমাকে আনতে হয়, আর এই চোরের দল, আমার দুঃখী মানুষের সর্বনাশ করে, এভাবে লুটতরাজ করে খায়।
তাই এবার আমি প্রতিজ্ঞা করেছি-যদি ২৫ বছর এই পাকিস্তানি জালেমদের বিরুদ্ধে-জিন্নাহ সাহেব থেকে আরম্ভ করে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে বুকের পাটা টান করে সংগ্রাম করে থাকতে পারি, আর আমার ত্রিশ লক্ষ লোকের জীবন দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারি, তাহলে পারব না? নিশ্চয়, ইনশাআল্লাহ পারব। এই বাংলার মাটি থেকে দুর্নীতিবাজ, এই ঘুসখোর, এই মুনাফাখোর, এই চোরাকারবারিদের নির্মূল করতেই হবে। আমিও প্রতিজ্ঞা নিয়েছি, তোমারাও প্রতিজ্ঞা নাও, বাংলার জনগণও প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করো।
আর না। ধর্যের সীমা হারিয়ে ফেলেছি। এই জন্য জীবনের যৌবন নষ্ট করি নাই। এই জন্য স্বাধীনতার জন্য রক্ত দেয় নাই। যে কয়েকটা চোরাকারবারি, ঘুসখোর, মুনাফাখোর, দেশের সম্পদ বাহির করে নিয়ে আসে, জিনিসপত্র গুদামজাত করে মানুষকে না খাইয়ে মারে। উৎখাত করতে হবে বাংলার বুক থেকে তাদের। দেখি কতদূর তারা টিকতে পারে। চোরের শক্তি বেশি, না ইমানদারদের শক্তি বেশি। সেইটাই এখন প্রমাণ হয়ে যাবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘অন্যায়ের কাছে কোনোদিন মাথা নত করি নাই। বারবার পাকিস্তানিরা আমাকে ফাঁসি দিতে চেয়েছে। বারবার বুক টান করে আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি। কারণ আল্লাহ আমার সহায় ছিল। বাংলার জনগণের আমার ওপর দোয়া ছিল। এখনো সেই দোয়া আছে।
ইনশাআল্লাহ, তোমাদের সাহায্য তোমাদের সহানুভূতি, তোমাদের কাজ, জনগণের ভালোবাসা আর ইমানদার মানুষের সহযোগিতায় এই দুষ্কৃতকারীদের নিমূর্ল করতেই হবে।’
বিএম জাহাঙ্গীর : উপসম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর