মঙ্গবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:২৬ pm
ডেস্ক রির্পোট : অন্যান্য দিনের মতোই রবিবার নিজ দফতরে গিয়েছিলেন তথ্য সচিব মকবুল হোসেন। সেখানে একটি বৈঠকে সভাপতিত্ব করছিলেন। আকস্মিকভাবে তার একজন ব্যক্তিগত কর্মচারী সভাকক্ষে প্রবেশ করেন। সচিবের কানে কানে কিছু বলেন। এর পরই তথ্য সচিব সভা থেকে উঠে যান। নিজেই খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সরকারি কর্মচারী আইনের ৪৫ ধারাবলে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
৪৫ ধারায় বলা হয়েছে : একজন সরকারি কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে সরকার তাকে অবসরে পাঠাতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো কারণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। আবার যে-কোনো সরকারি কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ ২৫ বছর পূর্ণ হলে তিনিও স্বেচ্ছায় অবসরের আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক অবসরের রীতি অনেক পুরনো। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকার এর যথেচ্ছ প্রয়োগ করেছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে ’৭৩-এর ব্যাচ নির্মূল করেছে এ বিধানবলে। এদিক থেকে অবশ্য আওয়ামী লীগ অনেক উদার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এ আইনের তেমন প্রয়োগ করেনি। বরং বিএনপি-জামায়াতপন্থি হিসেবে পরিচিত ও চিহ্নিত অনেককে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে প্রশাসনে ও পুলিশে আওয়ামীপন্থিদের বেছে বেছে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায়। এ নিয়ে সে সময় কেউ প্রতিবাদ করেনি। অনেক আমলাই নীরবে এ আইনের সমালোচনা করেন। কিন্তু প্রকাশ্যে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন। কিন্তু এবার মকবুল হোসেনের অবসর নিয়ে যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! চারদিকে হুলুস্থুল। যেন তথ্য সচিবই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাধ্যতামূলক অবসরের কাঁচিতে কাটা পড়লেন। সরকার তথ্য সচিবকে কেন বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করেনি। এটা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বা বাধ্যবাধকতাও নেই। কিন্তু এ নিয়ে প্রশাসনে, রাজনৈতিক আড্ডায় চলে অস্থির আলোচনা। মার্চে তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। নয়াপল্টনে বিএনপি কার্যালয়ের পাশে কোনো অফিসে যেতেন। দুর্নীতিসহ নানা মুখরোচক আলোচনায় টইটম্বুর দেশ। এ নিয়ে যখন আড্ডা জমে উঠেছে, ঠিক সে সময় মঙ্গলবার রাতে তিন পুলিশ কর্মকর্তাকেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবসরে পাঠাল। ব্যস, শুরু হয়ে গেল নানা গুঞ্জন, আলোচনা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মতো ‘মৌনব্রত’ পালন করেনি। মন্ত্রী এবং সিনিয়র সচিব দুজনই তাদের বিরুদ্ধে ‘অন্তহীন’ অভিযোগ আছে বলে উল্লেখ করেছেন। যে কারণেই করা হোক না কেন, এ চারজন কর্মকর্তাকে অবসরের মধ্য দিয়ে সরকার সুস্পষ্ট কিছু বার্তা দিয়েছে। প্রথম বার্তাটি হলো- সরকারের বিরুদ্ধে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে একটি গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করছে। দ্বিতীয় বার্তা হলো- সরকার এ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এবং তৃতীয়ত- এ ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে।
শুধু এ চার কর্মকর্তা নয়, বর্তমানে চাকরিতে আছেন কিংবা অবসরে গেছেন এরকম বেশকিছু কর্মকর্তার তৎপরতা রহস্যময়। সচিবালয়ে কান পাতলেই নানা কথা শোনা যায়। বিএনপি-জামায়াতপন্থি আমলা এবং পুলিশ প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তি এখন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন। তাদের মুখোশ খুলে যাচ্ছে। এতদিন যারা নিজেকে আওয়ামী লীগ প্রমাণের প্রাণান্ত চেষ্টা করে সফল হয়েছিলেন, সেসব ভাগ্যবান সরকারি কর্মকর্তা এখন গোপনে গোপনে আওয়ামী লীগের সমালোচনায় মুখর। দেশ রসাতলে যাওয়া নিয়ে তাদের বেদনা দীর্ঘ হচ্ছে। আর বিএনপির বিভিন্ন সাবেক আমলার সঙ্গে তারা এখন কুশল বিনিময় বাড়িয়েছেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে একটু আড়ালে বিএনপিপন্থি কাউকে একান্তে বলছেন, ‘আমি তো আপনাদেরই’।
রশাসনে মুষ্টিমেয় কিছু ‘দায়িত্বশীল’ কর্মকর্তার মধ্যে এ প্রবণতা চলছে কয়েক মাস ধরে। ১৫ বছরের নিদ্রা ভঙ্গ করে বিএনপি নেতারা মাঠে নেমেছেন। তাঁরা হুংকার দিচ্ছেন। সরকারকে ফেলে দেওয়ার দিন-তারিখ পর্যন্ত ঘোষণা করছেন। দু-একটি কর্মসূচি সফল হওয়ায় বিএনপি নেতারা দিশাহারা। একজন নেতা বললেন, সমাবেশে লাঠি নিয়ে যেতে হবে। আরেক নেতা আরও এককাঠি সরেস। বললেন, লাঠি আরও বড় হতে হবে। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য হলো জনমত সংগঠিত করে ক্ষমতায় যাওয়া। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বিরোধী আন্দোলনকে পরোক্ষভাবে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিরোধী দলের কাজই হলো আন্দোলন করা’। কিন্তু সেই আন্দোলন হতে হবে শান্তিপূর্ণ। গত দুই মাসে বিএনপির মধ্যে আন্দোলনকে সহিংস করে তোলার এক উগ্র প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। বিএনপি যেন চাইছে লাশ পড়ুক। মানুষ মারা যাক। সহিংসতা হোক। কারণ কী? তাহলে কি অন্যতম বিরোধী দলটি দেশে অশান্তি-বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়? একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা বদলের একমাত্র উপায় হলো নির্বাচন। বিএনপি বলছে, তারা নির্বাচনে যাবে না। আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবে। তার আগে এ সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। বিএনপির অবশ্য নির্বাচনে না যাওয়ার যৌক্তিক কারণ আছে। দলটির শীর্ষ দুই নেতাই নির্বাচনের অযোগ্য। তাই তর্কের খাতিরে আমরা যদি ধরেও নিই, ভোটে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল, তবু তো শীর্ষ দুই নেতার কেউই সরকারপ্রধান হতে পারবেন না। তাই অন্যকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য বিএনপি নির্বাচনে যাবে কোন দুঃখে। তার মানে, বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায় না, নির্বাচনও চায় না। বিএনপি একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করে আবার একটি এক-এগারো ঘটাতে চায়। এই তো চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহের পর খুলনার সমাবেশ নিয়ে বিএনপির আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চায়। দেশে একটি অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে চায়। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সেদিন রাখঢাক না করেই বলছেন, ‘বিএনপি আবার একটি এক-এগারো আনার ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্র সফল হবে না।’
ওবায়দুল কাদের যা-ই বলুন না কেন, বিএনপি যে তৃতীয় পক্ষকে ক্ষমতায় আনতে মরিয়া তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিকে কবর থেকে তুলে আনার চেষ্টার মধ্য দিয়েই প্রমাণিত। ২০০৭ সালে এক অসহনীয় ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এক-এগারো এসেছিল। ১১ জানুয়ারি একটি জগদ্দল পাথরের মতো অনির্বাচিত সরকার চেপে বসেছিল জনগণের বুকের ওপর। শুরু হয়েছিল বিরাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহননের এক কুৎসিত নোংরা খেলা। ২০০৭ সালের এক-এগারো সরকার ছিল আসলে সুশীলদের নীলনকশার বাস্তবায়ন। যারা নিজেদের বাইরে আর কিছুই বোঝে না। নিজেদের স্বার্থে সবকিছু করতে পারে। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ওই সুশীল নিয়ন্ত্রিত সরকার দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা বেসরকারি খাত ধ্বংসের উৎসব শুরু হয়েছিল। স্বনামধন্য ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের গ্রেফতার, হয়রানির নজিরবিহীন তাণ্ডব শুরু করেছিল সুশীল সরকার। শিল্পপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী উদ্যোগে অবৈধভাবে অভিযানের নামে চাঁদাবাজির প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। দুই বছরে বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা অবৈধভাবে চাঁদাবাজি করা হয়েছিল। লুট করা হয়েছিল। এসবের খুব কমই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছিল তখন। আতঙ্কে, ভয়ে, লজ্জায়, অপমানে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন। যাঁরা প্রতিবাদ করেছেন তাঁরা নিগৃহীত হয়েছেন। নির্যাতন ভোগ করেছেন। শুধু সুশীলরা ভালো আর সবাই খারাপ- এরকম একটি উদ্ভট তত্ত্বে দেশকে এক গভীর সংকটের অতল গহ্বরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। প্রশাসনে, বিচারালয়ে সর্বত্র আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়ে সুশীলরা অনন্তকাল দেশের মালিক হতে চেয়েছিলেন। দুই বছরে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। ভাতের বদলে আলু খাওয়ার নসিহত নিয়ে এসেছিলেন সুশীল অধিপতি। কিন্তু কৃষক ন্যায্য দাম না পেয়ে রাস্তায় আলু বিছিয়ে এক অভিনব প্রতিবাদ করেছিলেন। শিক্ষাঙ্গনে ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছিল। সম্মানিত শিক্ষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে ঢোকানোর মতো অমার্জনীয় অপরাধ করেছিল এক-এগারো সরকার। এক অনিশ্চিত আতঙ্কের জীবন থেকে মুক্তি পেতে হাঁসফাঁস শুরু করে জনগণ। বিদেশি প্রভু, যারা এ সুশীলদের কথায় গদগদ হয়ে এক-এগারো আগমনে পথ প্রশস্ত করেছিলেন, খুব শিগগিরই বুঝতে পারেন ‘ব্যাটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়’। একসময় বিদেশি প্রভুরাও প্রশ্রয়ের ছাতা সরিয়ে নেন। অবশেষে নির্বাচন দিয়ে কেটে পড়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম অথর্ব ও বিভীষিকাময় সরকারটি।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হয়তো সেই সময়কেই ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘আবার যেন অযোগ্যদের হাতে ক্ষমতা না যায় সেজন্য সজাগ থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী জেনে-বুঝেই কথাটা বলেছেন। ২০০৭ সালের ফখরুদ্দীন সরকার ছিল অনেকটাই ‘হীরক রাজার’ মতো। কয়েকজন তথাকথিত পণ্ডিতের খামখেয়ালিপনা যে দেশকে কী ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পারে ড. ফখরুদ্দীনের সরকার তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এ প্রেক্ষাপটেই সে সময় বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই না’। ড. আকবর আলি খান বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে’। মূলত ২০০৭ সালে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারই এ ব্যবস্থা সম্পর্কে গণ-অনাস্থা তৈরি করে। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল অনির্বাচিত অগণতান্ত্রিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরুদ্ধে ঐকমত্যে পৌঁছে। ড. ফখরুদ্দীনের সুশীল-শোভিত ‘এক-এগারো ফেরেশতা’ প্রমাণ করে দেয়, এ দেশের সুশীলরা একটি কাজই পারে, তা হলো অন্যের নিন্দা। সবার সমালোচনা। ওই বিভীষিকার দুই বছরে মানুষ ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। বিরক্তির মাত্রা এমন ছিল যে ‘সুশীল’ শব্দটাই এখন এক গালিতে পরিণত হয়েছে। সে সময়ই ‘আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার না’- এ ব্যাপারে এক জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই কিছু সুশীলের রাতারাতি দেবতা বনে যাওয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই সাধারণ মানুষকে যন্ত্রণায় দাহ করা। বিএনপির প্রয়াত নেতা তরিকুল ইসলাম ছিলেন এক-এগারোর একজন ভুক্তভোগী। সে সময় তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন, কারাবরণ করেছিলেন। জেল থেকে বেরিয়ে বলেছিলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তিন তালাক’। সেই বিএনপিই এখন আবার ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ফিরিয়ে আনার দাবিতে রাস্তায় লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হচ্ছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার মানেই এক-এগারো। বিএনপি কি তাহলে আবার একটি এক-এগারো ঘটাতে চায়? আবার বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র চায়? নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘নিকৃষ্ট গণতন্ত্রও অনির্বাচিত সরকারের চেয়ে ভালো’। বিএনপি কেন আবার সেই অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনতে চায়? বিএনপির অপরিণামদর্শী নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণেই ২০০৭ সালে এক-এগারো এসেছিল। এখন আবার দায়িত্বহীন রাজনীতির মাধ্যমে তারা তেমন একটা অবস্থার সৃষ্টি করতে চাইছে।
পাঠক লক্ষ করুন, ২০০৭ সালে এক-এগারো ঘটানোর ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল কূটনৈতিকপাড়া। বিএনপি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করেছিল ক্ষমতালিপ্সায়। এজন্যই বিচারপতি কে এম হাসানকে তারা প্রধান বিচারপতি করে। সংবিধান সংশোধন করে প্রধান বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে নিশ্চিত করা হয় তিনি যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হন। এরপর ‘একান্ত অনুগত’ রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে এই ব্যবস্থার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। দেড় কোটি ভুয়া ভোটার আর আজিজের মতো ভাঁড়কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে কার্যত নির্বাচনব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে দেয়। উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাজনীতির মাঠ। বিদেশি দূতাবাসগুলো তৎপর হয়। পশ্চিমা দেশগুলো আজ্ঞাবহ সুশীল সরকার গঠনে উৎসাহ দেয়। কারণ এতে তাদের খবরদারি করার সুযোগ বাড়ে। এবারও বিএনপি কথায় কথায় ধরনা দিচ্ছে কূটনৈতিকপাড়ায়। বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একঝাঁক দুর্বৃত্ত তোতাপাখির মতো বকবক করে যাচ্ছে বিরামহীন। পশ্চিমা দেশগুলোকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। তারা যেন আবার একটি অনির্বাচিত সরকারকে আনার সবুজ সংকেত দেয়। এমনকি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন! দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ কীভাবে এত আত্মঘাতী হতে পারেন? এক-এগারো আনতে বিএনপির কোনো কোনো নেতা ‘নারায়ে তাকবির’ স্লোগান দিয়ে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের ‘শহীদ’ বলার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছেন।
এক-এগারো ছিল সুশীলদের মাস্টারপ্ল্যান। দুই বছর নয়, ১০ বছর জনগণের ঘাড়ে চড়ে মধু খাওয়ার নীলনকশা। সে সময় সুশীলরা যেমন নিদ্রাহীন রাত কাটাতেন দেশের কথা ভাবতে ভাবতে, এখনো তারা তেমনি অবস্থায়। দীর্ঘদিন স্যুট-টাই সেলফে। সফেদ শার্টে জং ধরেছে। আগে তো পাঁচ বছর পরপর কিছু না করেই সবকিছু পাওয়া যেত। এখন ১৪ বছরের অপেক্ষা। এজন্য সুশীলরা কখনো অর্থনৈতিক সংকটের ভয় দেখাচ্ছেন। কখনো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিহরণ শোনাচ্ছেন। ২০০৭ সালে এ সুশীলদের নেতৃত্বে পরামর্শে টিএফআই সেলে কি নারকীয়তা হতো। কীভাবে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল সে সময়। তখন কোথায় ছিল মানবাধিকার? এখন আবার সুশীলরা ওত পেতে আছেন। বিএনপির আন্দোলনে তাদের দেহমনে চনমনে এক ভাব এসেছে দারুণভাবে। বিএনপির আন্দোলনের পালে হাওয়া লাগাতে তারাও এখন মাঠে নেমেছেন। এক-এগারোর অঘটন ঘটাতে আমাদের কিছু ভ্রষ্ট রাজনীতিবিদও কসরত করেছিলেন। ক্ষমতার হালুয়া-রুটি খেতে তারা নিজেদের আদর্শ, লজ্জা সব বিসর্জন দিয়েছিলেন ২০০৭ সালে। তাদের ‘সংস্কার’ ‘সংস্কার’ উল্লাস এখন ওই শব্দটিকেই করেছে দুর্গন্ধময়। এখনো রাজনীতিতে দেখুন। বিএনপি যেমন অহর্নিশ লাশের জন্য অপেক্ষা করছে, অনাসৃষ্টি প্রার্থনা করছে, আওয়ামী লীগের একটি অংশও সেই ষড়যন্ত্রের খেলায় বুঝে না বুঝে যোগ দিয়েছে। আওয়ামী লীগের হঠাৎ বনে যাওয়া কিছু মন্ত্রী বেশুমার লুটপাট, দুর্নীতি, অনিয়ম করে বেহেশতি সুখ উপভোগ করছেন। এদের ওপর মানুষের অসন্তুষ্টি, ক্ষোভ বেড়েই চলেছে। এরা যেন মনে করছেন ‘অদ্যই শেষ রজনী’। যা করার এখনই করে নিই।
আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নিজেদের মারামারি, খুনোখুনি এখন নিত্যকার ব্যাপার। কদিন আগে জেলা পরিষদ নির্বাচন হলো। কাগজে কলমে এটা নির্দলীয় নির্বাচন। কিন্তু আওয়ামী লীগই যেন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ। আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ অমান্য করে যাঁরা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন তাঁরাও দেশে এক-এগারো আনতে চান। এঁরাই গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি। গত এক যুগে আওয়ামী লীগে ব্যাপকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে বিএনপি-জামায়াত। এরা এতদিন নানা সুযোগ নিয়েছে। এখন ষড়যন্ত্রের অংশীদার। বিএনপির আন্দোলনে নানাভাবে বাতাস দিচ্ছে তথাকথিত এসব নব্য আওয়ামী লীগার।
দেশি-বিদেশি এ সম্মিলিত ষড়যন্ত্রই বাংলাদেশকে তুলে দিয়েছিল স্বার্থপর কিছু সুশীলের হাতে। এখন বিএনপি আন্দোলনের নামে তেমন একটি ফরমুলার পেছনেই ঘুরছে। এতে দেশের ভালো হবে না খারাপ হবে, সে চিন্তা চুলায় যাক। আওয়ামী লীগকে বিদায় করতে পারলেই যেন বিএনপি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বিএনপি, আওয়ামী লীগের একটি অংশ, সুশীলসমাজ, সুশীল নিয়ন্ত্রিত কিছু গণমাধ্যম, প্রশাসনের একটি অংশ এবং কয়েকটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিকের সর্বনাশা বিরাজনীতিকরণ ও উন্নয়নবিরোধী ফরমুলা এক-এগারো। ২০০৭ সালের সেই ক্রিয়াশীল শক্তিগুলো আবার সক্রিয় হয়েছে। কিন্তু ২০০৭ আর ২০২২ তো এক নয়। এ দেশের জনগণ কখনো সেই অযোগ্য, অপদার্থ শাসনে ফিরে যাবে না। ইতিহাসে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় না। তা ছাড়া আমাদের আছেন একজন বিশ্বনেতা। বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতায় যিনি অনন্য, অসাধারণ। তাঁর নাম শেখ হাসিনা। সূত্র : প্রবাসী বাংলা ডট টিভি