রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:৫১ pm
কোরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.) ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি বাদে আরেকটির চিন্তা অকল্পনীয়। পবিত্র কোরআনে মহানবীকে নিয়ে বেশ কিছু সূরার আয়াত নাজিল হয়েছে। এ লেখাতে পবিত্র কোরআনের ভাষায় বিশ্বনবী (সা.)বিষয়ক নির্বাচিত কিছু নাজিল হওয়া আয়াত বিভিন্ন শিরোনামের আলোকে সংকলিত করা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালাত পর্ব
রিসালাত মানে যা প্রেরিত হয়, চিঠিপত্র, পুস্তিকা। শরয়ী পরিভাষায় যেসব বিষয় প্রচারের ব্যাপারে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছেন তাই রিসালাত। আর রাসুল মানে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত দূত ও বার্তাবাহক। এ বিষয়টি নিয়ে পবিত্র কোরআনে একাধিক আয়াত-প্রবচন এসেছে।
* বল, হে মানুষ! আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহর রাসুল, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই; তিনিই জীবিত করেন ও মৃত্যুদান করেন। সুতরাং তোমরা ইমান আনয়ন কর আল্লাহর প্রতি, তার বার্তাবাহক দৃশ্যমান অক্ষরজ্ঞানশূন্য নবীর প্রতি যিনি আল্লাহ ও তার বাণীতে ইমান আনয়ন করে। এবং তোমরা তাকে অনুসরণ কর, যাতে তোমরা সঠিক পথপ্রাপ্ত হও। -সূরা আ’রাফ; আয়াত-১৫৮।
* মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল। তার সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি পরম সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় তুমি তাদেরকে রুকু ও সেজদায় অবনত দেখবে। -সূরা ফাতহ; আয়াত-২৯।
* মুহাম্মদ একজন রাসুল মাত্র। তার পূর্বে বহু রাসুল গত হয়েছে। -সূরা আলে ইমরান; আয়াত-১৪৪।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর গুণকীর্তন
* তোমাদের সঙ্গী বিভ্রান্ত নয়, বিপথগামীও নয়। এবং সে মনগড়া কোনো কথাও বলে না। এই কোরআন তো ওহি, যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে। তাকে শিক্ষাদান করে অত্যন্ত শক্তিধর সহজাত শক্তি ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন সত্তা। যা সে দেখেছে সে ব্যাপারে তার অন্তর মিথ্যা বলেনি। সে যা দেখেছে তোমরা কি সে বিষয়ে বিতর্ক করবে? নিশ্চয়ই সে তাকে আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের নিকট, যার সন্নিকটে অবস্থিত বাসোদ্যান। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি। দৃষ্টিও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নির্দেশনাবলি দেখেছিল। -সূরা নাজম; আয়াত ২-১৮।
* তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি উন্মাদ নও। তোমার জন্য অবশ্যই রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পুরস্কার। তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত। শিগগিরই তুমি দেখবে এবং তারাও দেখবে তোমাদের মধ্যে কে বেকারগ্রস্ত। -সূরা ক্বলাম; আয়াত ২-৬।
* নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসুল প্রেরণ করেছি। তোমাদের যা বিপন্ন করে তা তার জন্য কষ্টদায়ক। সে তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের জন্য সে দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু। -সূরা তাওবা; আয়াত-১২৮।
* আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। -সুরা আম্বিয়া; আয়াত ১০৭।
প্রিয় নবী (সা.)-এর শিক্ষাদান ও শুদ্ধিকরণ কর্মসূচি-
* যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট রাসুল প্রেরণ করেছি, যে আমার বাণীসমূহ তোমাদের নিকট পাঠ করে, তোমাদের পরিশুদ্ধ করে এবং কোরআন ও সুন্নাহ শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা জানতে না তাও শিক্ষা দেয়। -সূরা বাকারা; আয়াত-১৫১।
মুহাম্মদ (সা.)-একজন মহামানব ছিলেন
* বল, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই। আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ- একমাত্র ইলাহ। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাত পালনে কাউকে শরিক না করে। -সূরা কাহ্ফ; আয়াত-১১০।
* বল, আমি তো তোমাদের মতো একজন মানুষই। আমার ওপর প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ- একমাত্র ইলাহ। অতএব তোমরা তাঁরই পথ দৃঢ়ভাবে অবলম্বন কর এবং তাঁরই নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। দুর্ভোগ অংশীবাদীদের জন্য। -সূরা হা-মীম সাজদাহ; আয়াত-৬।
রাসুলুল্লাহ (সা.) হলেন সর্বোত্তম আদর্শ
* তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য তো আল্লাহর রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। -সূরা আহযাব; আয়াত-২১।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বশেষ নবী: * মুহাম্মদ তোমাদের মধ্যে কোনো পুরুষের পিতা নয়; বরং সে আল্লাহর রাসুল এবং শেষ নবী। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। -সূরা আহযাব; আয়াত-৪০।
হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন সরল পথপ্রদর্শক
* এভাবে আমি তোমার প্রতি প্রত্যাদেশ করেছি আমার নির্দেশ। তুমি জানতে না কিতাব কি এবং ঈমান কি? পক্ষান্তরে আমি একে করেছি আলো যা দ্বারা আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথনির্দেশ করি। তুমি তো কেবল সরল পথ প্রদর্শন কর। -সূরা শূরা; আয়াত-৫২।
মহানবী (সা.) দীনে ইসলামকে বিজয় করার জন্য সত্য ধর্মসহ প্রেরিত হয়েছিলেন: * তিনি পবিত্র ওই সত্তা যিনি তার রাসুলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপরাপর সকল দীনের ওপর একে বিজয় করার জন্য। -সূরা ফাতহ; আয়াত-২৮।
* তিনি পবিত্র ওই সত্তা যিনি তার রাসুলকে পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন অপরাপর সকল দীনের ওপর একে বিজয় করার জন্য। যদিও মুশরিকগণ তা অপছন্দ করে। -সূরা ফাতহ; আয়াত-২৮।
মুমিনদের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে করণীয় আচরণের রূপরেখা
* হে মুমিনগণ! আল্লাহ ও তার রাসুলের সমক্ষে তোমরা কোনো বিষয়ে অগ্রণী হইও না এবং আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ সর্বস্রোতা, সর্বজ্ঞ। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর নিজেদের কণ্ঠস্বরকে উঁচু কর না এবং নিজেদের মধ্যে যেভাবে তোমরা উচ্চস্বরে কথা বল তার সঙ্গে সেরূপ কথা বল না। কারণ এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে, তোমাদের অজ্ঞাতসারে। যারা আল্লাহর রাসুলের সম্মুখে নিজেদের কণ্ঠস্বর নিচু করে আল্লাহ তাদের অন্তরকে তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করে নিয়েছেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহাপুরস্কার। যারা ঘরের বাইরে থেকে তোমাকে ডাকে তাদের অধিকাংশই নির্বোধ। -সূরা হুজুরাত; আয়াত-১-৪।
মহানবী (সা.) সম্বন্ধে ঈসা আ.-এর সুসংবাদ প্রদান: * স্মরণ কর, মারইয়াম তনয় ঈসা বলেছিল, হে বনী ইসরাইল! আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর রাসুল এবং আমার পূর্ব হতে আমাদের নিকট যে তাওরাত রয়েছে আমি তার সত্যায়নকারী এবং আমার পর আহমাদ নামে যে রাসুল আসবে আমি তার সুসংবাদদাতা। -সূরা সাফ; আয়াত-৬।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওপর প্রত্যাদেশ সূচনাকালের বক্তব্য-* পাঠ কর তোমার প্রতিপালকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে সংযুক্ত রক্তপিণ্ড থেকে। পাঠ কর। আর তোমার প্রতিপালক মহামহিমান্বিত, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, যা সে জানত না। -সূরা আলাক; আয়াত ১-৫।
* হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! ওঠো, আর সতর্ক কর। এবং তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। তোমার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। পৌত্তলিকতা পরিহার করে চল। অধিক পাওয়ার আশায় দান করও না। এবং তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ধৈর্য ধারণ কর। -সূরা মুদ্দাসসির; আয়াত ১-৭।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঊর্ধ্বাকাশে গমন: * পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তার বান্দাকে রজনীতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত; যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নির্দেশ দেখানোর জন্য। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। -সূরা বনী ইসরাইল; আয়াত-১।
* নিশ্চয় সে তাকে (জিব্রাইল আ.) আরেকবার দেখেছিল প্রান্তবর্তী বদরী বৃক্ষের নিকটে, যার নিকট অবস্থিত বাসোদ্যান। যখন বৃক্ষটি যদ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ার তদ্বারা ছিল আচ্ছাদিত। তার দৃষ্টি বিভ্রম হয়নি। দৃষ্টি লক্ষ্যচ্যুতও হয়নি। সে তো তার প্রতিপালকের মহান নিদর্শনাবলি দেখেছিল। -সূরা নাজম; আয়াত ১৩-১৮।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাওয়াহ পর্ব: *অতএব তুমি যে বিষয়ে আদিষ্ট হয়েছ তা প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের উপেক্ষা কর। আমিই যথেষ্ট বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে। -সূরা হিজর; আয়াত ৯৪-৯৫।
* তোমার নিকটাত্মীয়বর্গকে সতর্ক করে দাও। -সূরা শুআরা; আয়াত-২১৪।
বদর প্রান্তরে রাসুলুল্লাহ (সা.)
* বদরের যুদ্ধে যখন তোমরা হীনবল ছিলে আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন। স্মরণ কর, যখন তুমি মুমিনগণকে বলছিলে, এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের প্রতিপালক প্রেরিত তিন সহস্র ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সহায়তা করবেন? হ্যাঁ, নিশ্চয়, যদি তোমরা ধৈর্য ধারণ কর এবং সাবধান হয়ে চল, তবে তারা দ্রুত গতিতে তোমাদের ওপর আক্রমণ করলে আল্লাহ পাঁচ সহস্র চিহ্নিত ফেরেশতা দ্বারা তোমাদের সাহায্য করবেন। -সূরা আলে ইমরান; আয়াত ১২৩-১২৫।
* স্মরণ কর, তোমরা ছিলে উপত্যকার নিকটপ্রান্তে এবং তারা ছিল দূরপ্রান্তে। আর উষ্ট্রারোহী দল ছিল তোমাদের অপেক্ষা নিম্নভূমিতে। যদি তোমরা পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত করতে চাইতে তবে এ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতভেদ ঘটত। কিন্তু যা ঘটার ছিল আল্লাহ তা সম্পন্ন করলেন, যাতে যে ধ্বংস হবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকবে সে যেন সত্যাসত্য স্পষ্ট প্রকাশের পর জীবিত থাকে। আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় অল্প। যদি তোমাকে দেখাতেন, তারা সংখ্যায় অধিক তবে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধবিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদের রক্ষা করেছিলেন। আর তিনি অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে বিশেষভাবে অবহিত। স্মরণ কর, তোমরা যখন পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছিলে তখন তিনি তাদেরকে তোমাদের দৃষ্টিতে স্বল্পসংখ্যক দেখিয়েছিলেন এবং তোমাদেরকে তাদের দৃষ্টিতে স্বল্পসংখ্যক দেখিয়েছিলেন যা ঘটার ছিল তা সম্পন্ন করার জন্য। সমস্ত বিষয় আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়। -সূরা আনফাল; আয়াত ৪২-৪৪।
হুনাইন প্রান্তরে হজরত মুহাম্মদ (সা.)
* আল্লাহ তোমাদের তো সাহায্য করেছেন বহু ক্ষেত্রে এবং হুনাইন যুদ্ধের দিনে যখন তোমাদের উৎফুল্ল করেছিল তোমাদের সংখ্যাধিক্য। কিন্তু তা তোমাদের কোনো কাজে আসেনি এবং বিস্তৃত হওয়া সত্ত্বেও পৃথিবী তোমাদের জন্য সংকুচিত হয়েছিল। পরে তোমরা পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে পলায়ন করেছিলে। অতঃপর আল্লাহ তাঁর নিকট হতে তাঁর রাসুল ও মুমিনদের ওপর প্রশান্তি বর্ষণ করেন এবং এমন এক সৈন্যবাহিনী অবতীর্ণ করেন যা তোমরা দেখতে পাওনি। এবং তিনি কাফেরদের শাস্তি প্রদান করেন। এটাই কাফেরদের কর্মফল। -সূরা তাওবা; আয়াত ২৫-২৬।
রাসুল (সা.)-এর অনুকরণের মাঝেই আল্লাহর ভালোবাসা নিহিত
* বল, তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা আলে ইমরান; আয়াত-৩১।
লেখক :মুফতী হাফিজুর রহমান, শিক্ষাসচিব, উচ্চতর ইসলামি শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-মা’হাদুল বুহুসিল ইসলামিয়া, বছিলা গার্ডেন সিটি, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।