শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১১:৩৪ am
‘জীবন একটি আয়না এবং চিন্তাকারীর কাছে সে যা চিন্তা করে তা প্রতিফলিত হবে’- এমন বিখ্যাত মতবাদের সাথে দ্বিমত করার যৌক্তিকতা নেই। এদিকে ‘মানুষ বিশৃঙ্খলার রঙধনুতে বাস করে’- এমন একটি উক্তিও প্রচলিত।
একদিকে, মানুষ চিন্তা করার শক্তি ও সময় নির্ধারণ করতে পারছে কিনা! অন্যদিকে, বিশৃঙ্খলাকে ডিঙিয়ে চেতনার সূর্য হয়ে তাঁর জীবন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘আদর্শ’ হয়ে দাঁড়াচ্ছে কিনা? দুইটি জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে মনুষ্য গোত্রের বুদ্ধিমান জীবকুলের সন্ধান নিশ্চিত হয়।
অর্থাৎ, যে মানুষ দর্পণ সন্ধানরত হয়ে সত্যান্বেষী এবং সামাজিক প্রতিকুলতাকে রুখে নিজের অঙ্গনকে অতি উপভোগ করে- এই দুই শ্রেণির মানুষ কৃতি সন্তান হয়ে দাঁড়িয়ে যাবেই। বাংলার মাটি, সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরখ করলে সাংস্কৃতিক মন একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়। তা হলো, একজন রাজনীতিক ও সুশাসক শেখ হাসিনাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসাবে দেখার অযুত যুক্তি দৃশ্যমান হয়।
মাদার তেরেসা বলেছিলেন, “আমি একা পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে পারব না, তবে আমি জলের উপর একটি পাথর নিক্ষেপ করতে পারি, যাতে করে অনেক ঢেউ তৈরি হয়।”- আলোচিত মতবাদের সাথে সদৃশ খুঁজতে যেয়ে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর নামকে স্মরণ করা যায়। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন।
বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের পথিকৃৎ সত্তা হয়ে তার ভূমিকা অসাধারণ পর্যায়ের ছিল। অতি অবশ্যই তার বুদ্ধিবৃত্তিক লেখনি শক্তি সাহিত্য ও সংস্কৃতির আকাশে আভিজাত্যের যে চিরায়ত রঙের ক্যানভাস, তা বিবর্ণ হয়নি আজও। তবে গভীর বাস্তবতায় মাদার তেরেসার অর্থবহ উক্তির সঙ্গে কোনো নারী চরিত্রকে নিয়ে চিন্তা করতে পারলে নামটি বেগম রোকেয়াই। আবার রোকেয়ার মতো করেই রাণী রাসমণি জনহিতৈষী কর্ম করেই যেন তার মতো করেই একই পথের পথিক। তেমন দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দেবী চৌধুরানীও এক মহীয়সী বাঙালি নারী।
অন্যদিকে বিপ্লবী সত্তার মানসে থাকা প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত, বীণা দাস, বাসন্তী দেবী কিংবা মাতঙ্গিনী হাজরাদেরকে স্মরণ করতে হবে বারংবার। অসীমা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রথিতযশা জৈব ও উদ্ভিদ রসায়নবিদ। সাহিত্য ও সংস্কৃতির আভিজাত্যের দিক দেখলে মহাশ্বেতা দেবী, সুফিয়া কামাল, অরুন্ধুতী, রাবেয়া খাতুন, সেলিনা হোসেনদের ইতিহাসে জায়গা দিতেই হবে। সুচিত্রা সেনের নায়িকাসুলভ ব্যক্তিত্বকে কার না ভালো লেগেছে! অভিনয় শিল্পের বিকাশে রুপা গাঙ্গুলির শিল্পীসত্তাকে ছাপিয়ে এখনো বড় কোন চরিত্র ধরা দেয়নি।
রাজনীতিতে আমাদের জোহরা তাজউদ্দীন, মতিয়া চৌধুরী কিংবা ওপার বাংলার মমতা ব্যানার্জিকে শ্রেষ্ঠ পর্যায়ের রাজনৈতিক সত্তা বলতেই হবে। তবে একজন শেখ হাসিনা যেন এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। সাগর পাড়ি দিয়ে সেই নৌকার মাঝি, যিনি এখন ভারতকে দেখেন, চীন কী করছে তা দেখেন। সাত সমুদ্দুর পার হয়ে যেয়ে পশ্চিমাদের কিংবা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির দিকেও তাকিয়ে বলতে পারেন, আমার নাম শেখ হাসিনা।
ব্যক্তিসত্তার বিশালতায় শেখ হাসিনাকে ছাপিয়ে যেয়ে বাঙালি কোনও নারী যেতে পারছেন, তা বিশ্বাস করার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় না। বড়সড় নেতৃত্বের মৌলিক গুণাবলির মধ্যে সততা, মেধা, দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম ও চরিত্র থাকতেই হবে। শেখ হাসিনার পাঁচটি গুণই আছে। তিনি নিজে একজন সৎ ব্যক্তি। তার মেধা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। প্রখর দূরদৃষ্টি দিয়ে তিনি জীবনকে দেখেন, বাংলাদেশকে দেখেন। সব সময় নিজের অজান্তে বাংলার মাটির কথা বলেন। তার প্রবল দেশাত্মবোধ অন্যদের থেকে তাকে আলাদা করে দেয়। তার ধার্মিক মন এবং সহনশীল আচার ও সত্যিকারের মা হতে পারার মধ্য দিয়ে বাঙালি নারী হিসেবে তার তুলনা তিনি নিজেই। সম্প্রতি সময়ে আমি বলেছি, একান্ন বছরের বাংলাদেশে তিনিই নিউক্লিয়াস। তাকে ঘিরেই মানুষ ভাগ্য পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে। চিন্তা না করলে টানা তিন মেয়াদে তিনি রাষ্ট্রীয় সেবায় থাকতে পারতেন না।
“নেতৃত্ব একটি ব্যক্তি বা একটি অবস্থান নয়। এটি মানুষের মধ্যে একটি জটিল নৈতিক সম্পর্ক, যা বিশ্বাস, বাধ্যবাধকতা, প্রতিশ্রুতি, আবেগ এবং ভালোর একটি ভাগ করা দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে।”- এমন বিখ্যাত মতবাদের সাথে এই বিশ্বের রাজনীতিকদের মধ্যে কার সাথে যায়? মানুষটির নাম শেখ হাসিনা।
মোদ্দকথা হলো, “আপনার সিদ্ধান্তের গুণগতমান আপনার জীবনের মান নির্ধারণ করে।” শেখ হাসিনা তা প্রমাণ করেছেন। তার ক্ষেত্রে আরেকটি দর্শন অনুপ্রেরণার মতো হয়ে দাঁড়ায়। যখন ব্যক্তিবিশেষ বলেছিলেন যে, প্রশ্নটি এই নয় যে, “কে আমাকে অনুমতি দেবে; আমাকে আটকাবে কে?” শেখ হাসিনার পথচলাকে আটকে রাখার সামর্থ্য কারোর নেই। তিনি অদম্য, তিনি দুর্ভেদ্য দেয়াল টপকিয়ে চ্যালেঞ্জ নিতে জানেন। সেই চ্যালেঞ্জ নিজের ভোগবিলাসের জন্য নয়, পুরোটাই বাংলাদেশের জন্য।
২৮ সেপ্টেম্বর, শেখ হাসিনার জন্মদিন। আমি তার জন্মদিবস নিয়ে খুব সকাল থেকেই ভাবছিলাম। মনে হলো, লিখে বলা দরকার যে, ওই মানুষটিই যে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নারী। এই প্রসঙ্গে আমি বিশদ ধারাভাষ্য দিয়ে কয়েকটি কলাম পরেও লিখতে চাই। একটু প্রার্থনাও আলাদা করে সেরে নিলাম। মহান স্রষ্টাকে বললাম, তাকে দেখে রেখো। পুনরায় আরো একটি বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করে বলা যায় যে, প্রার্থনা হলো একটি চিন্তা, একটি বিশ্বাস, একটি অনুভূতি, যা প্রার্থনাকারীর মনে উদ্ভূত হয়। লেখক : এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও মেয়র, রাজশাহী সিটি করপোরেশন।