মঙ্গবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৬:৩৩ pm
ডেস্ক রির্পোট : বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে সরকারের ১৩ লাখ তালগাছ লাগানোর প্রকল্পটি ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে আরও দুটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে বজ্রনিরোধক দণ্ড (লাইটনিং অ্যারেস্টার) বসানো হবে। প্রাথমিক ও পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি জেলায় এই দণ্ড বসানো হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১৮ দিনে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন অন্তত ১৯ জন।
গত ১২ বছরে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছেন ২ হাজার ৮৫৪ জন। আর চলতি বছরের সাড়ে ৯ মাসে মারা গেছেন ২৬৪ জন। এই প্রেক্ষাপটে বজ্রপাত ঠেকাতে সরকারের করণীয় কী, তা আবারও আলোচনায় এসেছে।
বজ্রপাতের ক্ষেত্রে একটি অস্বাভাবিক বছর ছিল ২০১৬ সাল। ওই বছর প্রায় ৪৩ লাখ বজ্রপাতে মারা যান প্রায় ২৬৩ জন মানুষ। সে বছর বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার।
বজ্রপাতে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এর এক বছর পর সারাদেশে প্রথমে ১৩ লাখ তালগাছ রোপণের উদ্যোগ নেয় সরকার। তখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তালগাছ ও নারকেল গাছ রোপণ করা হলে সেগুলো বজ্রনিরোধক দণ্ড হিসেবে কাজ করবে। অবশ্য এই প্রকল্প নিয়ে সরকারকে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয় ।
চলতি বছরের ১১ মে সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাত মোকাবিলার কৌশলে ইতি টানার কথা সাংবাদিকদের জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এনামুর রহমান দৈনিক বাংলাকে বলেন, তখন তালগাছ লাগানোর পরে দেখা গেল, যত্নের অভাবে সেগুলো মারা যাচ্ছে। তাই শেষ পর্যন্ত এটি বাতিল করা হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশের কোন কোন অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হয় (হটস্পট), তা বের করতে অধিদপ্তর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটির আলোকে বজ্রপাতের হটস্পটগুলোতে বজ্র নিরোধক দণ্ড বসানোর প্রকল্প নেয়া হবে। ইতিমধ্যে প্রাথমিকভাবে (পাইলট প্রকল্প) ১৫টি জেলায় ৩২০টি বজ্রনিরোধক দণ্ড বসানো হয়েছে। এ ছাড়া আবহাওয়ার পরিস্থিতি বুঝে সতর্ক সংকেত (আর্লি ওয়ার্নিং) দেয়ার কথাও ভাবছে অধিদপ্তর।
রোপণ করা তালগাছগুলো কী ভূমিকা রেখেছে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, ২০১৭ সালে রাস্তার দুই পাশে তালগাছ রোপণ করা হয়েছিল। তালগাছ বড় হতে অনেক সময় নেয়, ৩০ থেকে ৪০ বছর লাগে। তাই, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা সম্ভব ছিল না। তাঁর মতে, বজ্রনিরোধক দণ্ড বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য একটি গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত।
দুই মন্ত্রণালয়ের দুই প্রকল্প :
বজ্রপাতের কারণে হতাহতের সংখ্যা কমাতে সরকারের দুই মন্ত্রণালয় দুটি আলাদা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের হাওরাঞ্চলের বজ্রপাতপ্রবণ ২৩ জেলায় বজ্রপাত-নিরোধক কংক্রিটের ছাউনি (শেল্টার) নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের খরচ ৩০০ কোটি টাকা। একেকটি ছাউনি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এসব ছাউনিতেও বজ্র নিরোধক দণ্ড বসানো হচ্ছে।
অন্যদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘হাওরাঞ্চলে কৃষকদের জীবনের সুরক্ষায় বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পে ব্যয় ২৩১ কোটি টাকা। এর আওতায় হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার ৫৮টি উপজেলায় ১০০ থেকে ১২০ বর্গমিটার ব্যাসার্ধের ১৬টি আর্লি স্টিমার ইমিটার (ইএসই) নামে বজ্রনিরোধক যন্ত্র বসানো হচ্ছে। পাশাপাশি ‘আর্থ নেটওয়ার্কস লাইটিং অ্যান্ড সিভিয়ার ওয়েদার আর্লি ওয়ার্নিং সল্যুশন’-এর মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ, ভয়েস ও খুদেবার্তার আকারে স্থানীয়দের সতর্কবার্তা দেয়া হবে।
বাংলাদেশের বজ্রপাত নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড প্লানেটারি সায়েন্সেসের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আশরাফ দেওয়ান। তিনি দৈনিক বাংলাকে বলেন, বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এখন অ্যারেস্টার, ছাউনি এবং আর্লি ওয়ার্নিং পদ্ধতির ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। অ্যারেস্টারের গুণগত মান ও ব্যবহারের আগে কার্যকারিতার সম্ভাব্যতা যাচাই অপরিহার্য। সঠিকভাবে অনুসরণ না করলে এগুলো মৃত্যু কমানোর বিপরীতে বাড়াতে পারে।
বজ্রপাত কমলেও তা শক্তিশালী :
দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা অবশ্য কমলেও সেটা উদ্বেগ কমানোর মতো নয়। কারণ, এখনও বছরে প্রায় ২৩৮ জন মানুষের মৃত্যু হয় ভূমিতে নেমে আসা বজ্রপাতে। আর মারা যাওয়াদের প্রায় অধিকাংশই কৃষক বা মাঠে কাজ করার সময়।
ফিনল্যান্ডের বজ্রপাতবিষয়ক গবেষণা সংস্থা ভাইসালারের হিসাবে বাংলাদেশে ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৪০ লাখ বা তার বেশি বজ্রপাত হয়। ২০১৯ সালে তা প্রায় ১০ লাখ কমে যায়। ২০২০ সালে বজ্রপাতের সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২৫ লাখের কিছু কম।
ভাইসালারের সাত বছরের তথ্য বলছে, দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর ৭০ শতাংশ ঘটনা ঘটে কৃষিকাজ করার সময়। এ ছাড়া বাড়ি ফেরার পথে সাড়ে ১৪ শতাংশ এবং গোসল করা ও মাছ ধরার সময় ১৩ শতাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এই তথ্যের মিল পাওয়া গেল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের এক হিসাবে। অধিদপ্তর জানায়, চলতি বছরের শুরু থেকে গত ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা যাওয়া ২৬৪ জনের মধ্যে ২৬০ জনই পেশায় কৃষক বা মাঠে কাজ করার সময় মারা গেছেন।
২০২১ বজ্রপাতে মৃত্যুর জেলাওয়ারী হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৬ জন। ১৬ থেকে ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, দিনাজপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলায়। ১২ থেকে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, রাজশাহী ও বগুড়ায়।
গবেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে সংখ্যাটা কমলেও সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে হতাহতের সংখ্যা বেশি হতে দেখা যাচ্ছে। গাছপালা কমে যাওয়া, মাঠে উঁচু গাছ না থাকা এবং পানির কাছাকাছি থাকার কারণে বাহক হিসেবে মানুষ বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন। এ ছাড়া মৌসুমী বজ্রপাতের কারণ মূলত মৌসুমী বায়ুর প্রভাব।
গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের ভূমিরূপের কারণেও বজ্রঝড় বেশি হয়। প্রাক-মৌসুমে দেশে অন্য মৌসুমের তুলনায় বজ্রপাত বেশি হয়। যার মূল কারণ কৃষিতে সেচকাজ- যা ভূমি ও বায়ুমণ্ডলের এনার্জি এক্সচেঞ্জকে প্রভাবিত করে। গাণিতিক ও আবহাওয়ার মডেল অনুযায়ী, প্রাক-মৌসুমে বজ্রপাত ও ঝড়ের তীব্রতা বাড়ে, অন্য সময়ে কমে। আর প্রাক-মৌসুমে যে বজ্রপাত হয়, তার তীব্রতা অনেক বেশি থাকে। ফলে প্রাণহানির আশঙ্কাও বেশি।
আশরাফ দেওয়ান দৈনিক বাংলাকে বলেন, মূলত বজ্রপাতগুলো বৃহৎ শক্তি (ভোল্টেজ) নিয়ে ভূমিতে আছড়ে পড়ছে। ভূমিতে নামার সময় বজ্রপাত উঁচু বাহক খোঁজে। মাঠে উঁচু গাছ কম এবং ওই পরিবেশে গাছপালাও কমে যাচ্ছে। ফলে বজ্রপাত বাহক হিসেবে বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, হতাহতও বাড়ছে।
উদাহরণ দিতে গিয়ে এই গবেষক বলেন, ২০২১ সালের ৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পদ্মা নদীর তেলিখাড়ি ঘাটে বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন ৬ জন। তাঁরা সবাই ঘাটে পানির কাছাকাছি ছিলেন। আবার এ বছর ৮ সেপ্টেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় বজ্রপাতে একই পরিবারের ৫ জনসহ ৯ জনের মৃত্যু হয়। তারা সবাই মাঠে কৃষিকাজ করছিলেন। ফলে একসঙ্গে এতগুলো বাহক পেয়ে বজ্রপাত তার পূর্ণ শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। সূত্র : দৈনিক বাংলা