কিছু নির্মাণসামগ্রী দোকান থেকে নির্মাণাধীন ভবনে আনার জন্য দোকানদার ২০০ টাকায় ভ্যান ঠিক করে দিলেন। ভাড়া দিতে গেলে ভ্যানচালক আস্তে করে বললেন, ‘স্যার, আরেকটু ধরই দিয়েন।’ আমি বললাম, ‘কেন? দোকানদার তো ২০০ টাকায় ভাড়া ঠিক করে দিল।’ ‘ভাড়া আসলে ২০০ টেকাই। কিন্তু এখন আর পুষাইছে না। চাল-ডাল-তেলের দাম যা বাড়িছে, তাতে আমরা কী করি চলব? মানুষও কাজ কমা দিইছে। আগের মুতোন ভাড়া পাছি না।’
৩.
কিছু টাইলস নয়তলায় ওঠানোর জন্য ভবনের কয়েকজন শ্রমিককে এক হাজার টাকায় মেটানো হলো। কাজ শেষে এক শ্রমিক বললেন, ‘স্যার, এত ওপরে তোলা খুব কষ্টের। হারঘে কিছু ধরি দিয়েন।’ বললাম, ‘আবার বেশি কেন?’ তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনারা একটু বেশি না দিলে হামরা কুনঠে যাব। বাজারের যা অবস্থা, হারঘে তো আর চলছে না।’
সন্ধ্যার পর সেদিন কাজলা গেট থেকে কলাভবনে এসে ১০ টাকা ভাড়া দিলাম। রিকশাচালক দেখলাম টাকার দিকে তাকিয়ে আছেন, মনে হচ্ছে কিছু বলতে চান। আমি নিজেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোনো সমস্যা?’ ‘না স্যার, আর ৫ টেকা দিলে ভালো হয়।’ ‘সব সময় তো ১০ টাকা করেই দিই।’ ‘৫ বছর আগেও ১০ টেকা দিছেন, ৫ বছর পরেও ১০ টেকায় দ্যান।
জিনিসের দাম তো আর আগের মুতোন নাই। সবকিছুর দাম বাড়ছে, শুধু গরিবের কাজের দাম বাড়ছে না।’ ওই রিকশাচালকের এ কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। বললাম, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, রিকশাভাড়াও বাড়া উচিত। সব জিনিসেরই তো দাম বেড়েছে।’ পরে প্রক্টর অফিসে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, ক্যাম্পাসে এই ভাড়া ঠিক হয়েছে ২০১৭ সালে। এরপর আর ভাড়া বাড়েনি।
৫.
বিভাগের কর্মকক্ষে বসে আছি। ভবনের সামনের চায়ের দোকানের নজরুল একটি দরখাস্ত নিয়ে এসে সেখানে সুপারিশ করে দিতে বললেন, যেন তিনি তাঁর দোকানটা আবার দিতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর দোকান তুলে দিয়েছে। করোনার প্রকোপ কমে আসার পর সবকিছু স্বাভাবিক হতে থাকলে ক্যাম্পাসে ছোটখাটো অনেক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী খাবারসহ নানা ধরনের পণ্যের দোকানপাট নিয়ে বসতে শুরু করেন।
ফলে একাডেমিক ভবনগুলোর আশপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো পলিথিনের ছাউনি দিয়ে যত্রতত্র দোকানপাট গজিয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত প্রশাসন নোটিশ দিয়ে সবাইকে তুলে দিয়েছে। পরে অবশ্য নিয়ম মেনে কিছু জায়গায় আবার দোকান করার অনুমতি দিচ্ছে।
কিন্তু ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক যে একটি বড় অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল কিছু অসহায় মানুষের জন্য, তাঁদের অনেকের জীবিকা ভীষণ ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।
৬.
কিছুদিন আগে রাজশাহী শহরে অটোরিকশাচালকেরা ভাড়া বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট ডেকেছিলেন। কিন্তু নগর কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবি উপেক্ষা করে শহরে টাউন সার্ভিস নামানোর ঘোষণা দিল এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটি বাস্তবায়নও করল।
উপায়ান্তর না দেখে বেচারা অটোচালকেরা তাঁদের ভাড়া বাড়ানোর ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু যেখানে পরিবহন খাতে ভাড়া বেড়েছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাঁদের জীবন নির্বাহের ব্যয় অনেক বেড়েছে, সেখানে ভাড়া বৃদ্ধির যৌক্তিক একটি দাবিকে পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করা কতটুকু সঠিক, সেটি ভাবার বিষয়।
৭.
দুপুরে জুবেরী ভবনের সামনের আমবাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটাপথ ধরে বাসায় ফিরছি। দেখলাম একটি আমগাছের নিচে গোল হয়ে কয়েকজন নির্মাণশ্রমিক একসঙ্গে বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে নারীই বেশি। কাছে গিয়ে কথা বলে জানলাম, তাঁরা সবাই ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর। অনেক দূর থেকে কাজে এসেছেন।
খুব সকালে একসঙ্গে একটি নছিমনে (ইঞ্জিনচালিত ভ্যান) করে কাজে আসেন, আবার কাজ শেষে সেই নছিমনে চড়ে বাড়ি ফেরেন। বাজারের বাড়তি দামের আঁচ তাঁদের দারিদ্র্যক্লিষ্ট সংসারে গভীর প্রভাব ফেলেছে। বাড়ি থেকে নিয়ে আসা খাবারে সেই চিহ্ন স্পষ্ট। মজুরি বাড়েনি, কিন্তু যোগাযোগ খরচ বেড়েছে, বিভিন্ন নিত্যব্যবহৃত পণ্যের দাম বেড়েছে। খাবার কমিয়ে দিয়ে কোনোরকমে খেয়ে না–খেয়ে বেঁচে আছেন এসব প্রান্তিক মানুষ।
শুধু রাজশাহী নয়, এসব ঘটনা দেশের প্রতিটি শহরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাস্তব চিত্র। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার কারণে চাপে পড়েছেন সীমিত আয়ের এসব মানুষ।
আয় না বাড়ায় পরিবার নিয়ে জীবিকা নির্বাহে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের। ফলে একটু ‘বাড়িয়ে’ দেওয়ার যে দাবি দেশের আনাচকানাচে উঠছে, সেটি অত্যন্ত যুক্তিসংগত এবং ন্যায্য। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন এই নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যাঁদের উপার্জনের বেশির ভাগ ব্যয় হয় খাবারের পেছনে।
তাঁদের কাছে মূল্যবৃদ্ধি মানে কম খেয়ে থাকা। প্রতিদিন খিদেপেটে ঘুমাতে যাওয়া। ঘুম থেকে জেগে খেয়ে না–খেয়ে কাজে ছুটে চলা।
দেশের চা–শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে পেরেছিলেন, ফলে তাঁদের দাবি আংশিক হলেও আদায় সম্ভব হয়েছে। দেশের রিকশা কিংবা অটোরিকশাচালক, ভ্যানচালক, নির্মাণশ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার নিম্ন আয়ের মানুষের কথাও রাষ্ট্র ও সমাজকে ভাবতে হবে।
নজরুলের চায়ের বিকল্প হয়তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আছে কিংবা রাজশাহী শহরের অটোরিকশার বিকল্প হয়তো নগর প্রশাসনের কাছে আছে, কিন্তু এই প্রান্তিক মানুষ এবং তাঁদের পরিবারের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ ও অধিকারের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। তাঁদের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। রাষ্ট্রের ‘উন্নয়ন–আধিপত্যের’ নিচে প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার মৌলিক প্রশ্নটি যেন চাপা পড়ে না যায়।
ড. ফরিদ খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, [email protected] সূত্র : প্রথম আলো