বুধবা, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:৪০ am
নিজস্ব প্রতিবেদক : তীব্র দাপদহ, খরা এবং জলবায়ু পরির্বনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে নতুন নতুন কিছু সংকট দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন খরার কারণে পানি সংকট আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পানিকে কেন্দ্র করে বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাজ ব্যবস্থায় সহিংসতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী রেশম শিল্পের উপরও প্রভাব ফেলেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অস্বাভাবিক তাপমাত্রা উঠা নামার কারণে রেশম পলু পোকা পালনে বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছেন পলু পোকা চাষীরা। বেড়েছে তাদের উৎপাদন খরচও। বরেন্দ্র অঞ্চলের অন্যতম লাক্ষা চাষেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গবেষণার প্রাথমিক সারসংক্ষেপ ও সার্বিক দিক বিবেচনায় এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার সকালে রাজশাহীর কাজলাস্থ হেরিটেজ আর্কাইভস বাংলাদেশ মিলনায়তনে জলবায়ু পরিবর্তন ও বরেন্দ্রভূমির নয়া সংকট বিষয়ক গবেষণা উপস্থাপন ও নীতি সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এবং বরেন্দ্র অঞ্চল জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি এ সংলাপের আয়োজন করেন। সংলাপে গবেষণা পত্র উপস্থাপনকালে স্থানীয় গবেষক, কৃষক, উন্নয়ন কর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, তরুণ ও নাগরিক সমাজ চলমান সময়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের সংকটগুলো তুলে ধরেন।
গবেষণা উপস্থাপন ও নীতি সংলাপে বলা হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব অন্যদিকে মানুষ দৃষ্ট দুর্যোগগুলোও বরেন্দ্র জনগন এবং এই অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্যের ক্ষতি ডেকে আনছে। অস্বাভাবিক এবং অনিয়ন্ত্রিত রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মধ্যে পড়েছে। আবার কীটনাশকের ব্যবহারের ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা তাদের ক্ষতি অনুযায়ী পায়না ন্যায্য ক্ষতিপূরণ।
খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার প্রধান বার বার সকল ধরনের জমি ব্যবহার বৃদ্ধি করার কথা জানিয়েছেন। অথচ গবেষনায় উঠে এসেছে এই অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থানীয়ভাবে আবহাওয়া ও খরার কারনে কিছু এলাকায় অনাবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে। আবার পানির অভাবে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খরাপ্রবণ এলাকাগুলোতে ৩০% জমি কোন না কোন ভাবে অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। এমন কি কোন এলাকায় তারও বেশি জমি পরিত্যাক্ত জমি থেকে যাচ্ছে। একই সাথে প্রান্তিক কৃষক জমি হারাচ্ছে। সমীক্ষা এলাকায় ১০টি কেসস্টাডির মাধ্যমে দেখা যায় ১৯৭১ সাল থেকে জুন/২০২২ পর্যন্ত গড়ে অন্তত ১০টি পরিবার তার ৭০% জমি হারিয়েছেন।
সার্বিক ক্ষেত্রে জনগোষ্টীর মতামত এবং প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণসহ গবেষণার তথ্য পর্যালোচনা সাপেক্ষে সংলাপে উপস্থাপন করা হয়েছে, বরেন্দ্র অঞ্চলের যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তা অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক বেশি।
বিশেষ করে আবহাওয়া অফিসের তথ্যানুযায়ী দেখা যায় এই অঞ্চলে গড়ে প্রতিবছর ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা গড়ে বাড়ছে। তীব্র তাপদহ এবং অনাবৃষ্টি বেড়েছে যাচ্ছে। এর ফলে মানুষ নানামূখী ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন। প্রান্তিক এবং আদিবাসী মানুষ তার জীবন জীবিকা হারাচ্ছেন। জীবন জীবিকার তাগিদে স্থানান্তরিত হচ্ছেন মানুষজন।
সংলাপের মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চলটি প্রাণবৈচিত্র্য ও বহুসংস্কৃতির ভৈরবে একটি অনন্য ঐতিহ্যবাহী আদিভূমি। এখানে রয়েছে নানা জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সহবস্থান। কিন্তু দিনে দিনে বৈশ্বিক জলবায়ুর আঞ্চলিক অভিঘাত এবং মনুষ্যসৃষ্টসহ নানা কারণে প্রাণবৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, উঁচু-নীচু ভূমি, মাঠ, খাল-খাড়ি, বিল, নদ-নদী, পুকুর, প্রাকৃতিক জলাধার, বন আজ অনেকটাই হুমকির মুখে। উক্ত বিষয়গুলোর উপর নির্ভরশীল মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণ ও সংস্কৃতিও হুমকির মুখে।
প্রাণ ও প্রকৃতির উপর পরস্পর নির্ভরশীলতা কমে যাওয়ায় দিনে দিনে সহিংসতা বাড়ছে। একই সাথে হারিয়ে যাচ্ছে বা বিলুপ্তির পথে স্থানীয় এলাকা উপযোগী উৎপাদনশীল নানা শস্য ও ফসলের জাত। কোন কিছু হারালে শুধু সেটিই হারিয়ে যায় না, তার সাথে যে সংস্কৃতি থাকে সেটিও হারিয়ে যায় বলেও মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
বারসিক বিগত দিনের অভিজ্ঞতা এবং বরেন্দ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মতামত পরামর্শে নীতি গবেষণা ও এডভোকেসীর বিভিন্ন দিক ও কাজগুলো উক্ত সংলাপে তুলে ধরেন।
উল্লেখ্য যে, বারসিক স্থানীয় গবেষক, সাংবাদিক এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে বরেন্দ্র এলাকার গ্রামীণ জনজীবনে তীব্র্র তাপদাহের প্রভাব, কৃষি জমির সংকট রুপ এবং সমাধানে করণীয় বিষয়ক মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষা, কীটনাশকের অপব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর প্রভাব, লাক্ষা চাষ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, রেশম পলু পোকা পালন ও আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক অনুসন্ধান, গ্রামীণ নারীর স্থাপত্যজ্ঞান ও স্থাপত্যকলা, করোনাকালিন শতবাড়ি উন্নয়ন মডেল, তীব্র তাপদাহ ও খরা নারীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিষয়ক অনুসন্ধান, বরেন্দ্র অঞ্চলের দুর্যোগ প্রস্তুতি বিষয়ক মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষার কাজ করেন। উক্ত গবেষণার ফলাফলগুলো গবেষক উপস্থাপন করেন।
গবেষণা উপস্থাপন ও নীতি সংলাপে বরেন্দ্র অঞ্চল ও কার্যকর উন্নয়ন বিষয়ে কথা বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাটেনারি এন্ড এনিমেল সাইন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. শরিফুল ইসলাম, নদী ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দকী, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রাজশাহীর তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এটিএম মাহফুজুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউটের সিনিয়র গবেষক আফতাব উদ্দিন, পরিচালক (প্রশাসন) ফরহাদ হোসেন, রাজশাহী ব্যবসায়ী সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার আলী, সেভ দি নেচার রাজশাহী চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, বারসিক সমন্বয়কারি জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।
অনুষ্ঠানের সভাপ্রধান হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় কৃষি পদক প্রাপ্ত কৃষক নুর মোহাম্মদ। গবেষণা উপস্থাপন ও নীতি সংলাপে সঞ্চালনা করেন এবং ধারণাপত্র তুলে ধরেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারি ও গবেষক শহিদুল ইসলাম।
সংলাপে গবেষণাপত্র উপস্থাপন ও গবেষণার বিভিন্ন দিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন সাংবাদিক রিমন রহমান, শাহমখদুম ম্যানেজমেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সাবরিন নাহার, গবেষক জয়নাল আবেদিন সবুর ও বারসিক গবেষক শহিদুল ইসলাম।
একই সাথে নিজ নিজ এলাকা এবং সংকটগুলো তুলে ধরেন নাচোল উপজেলার লাক্ষা চাষী ইসমাইল হোসেন, তানোর উপজেলার বাঁধাইড় ইউনিয়নের কৃষক মাহবুবর রহমান, আদিবাসী সংগঠক সুভাষ চন্দ্র হেমব্রম। আজকের তানোর