রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১২:৩৬ am
আজকের তানোর ডেস্ক : ১৯৭৫ সালের সেই কালরাতে সব হারিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই মেয়ে বিদেশের মাটিতে দিশেহারা। একদিকে স্বজনহারা, আরেক দিকে নিজেদের নিরাপত্তার চিন্তা। ১৫ আগস্টের পর থেকে মূল চিন্তা হয়ে উঠলো—তাদের নিরাপদ বাসস্থান। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ রেহানা বিভিন্ন সময় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রধান সংকট ছিল আর্থিক।
ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং নিরাপদে থাকার মতো বিষয়গুলো তখন একইসঙ্গে ভাবতে হচ্ছিল।
শেখ হাসিনার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়ার অবস্থা তখন একজন অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো। নিজেদের অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি গভীরভাবে চিন্তিত। যদিও কিছু মানুষ ওই দুঃসময়েও তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এবং তাদের জন্য কিছু করতে চেয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার লড়াই-সংগ্রামের জীবন নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। ‘হে সন্তপ্ত সময়’ নামের উপন্যাসে ১৯৭৫-৮১ কালপর্বে বৈরী বাস্তবতায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং ভারতে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের সংগ্রামমুখর জীবন নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। জার্মান প্রবাসী লেখক সরাফ আহমেদ প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ের দুঃসহ জীবন গ্রন্থে সম্প্রতি লিখেছেন— সেই সময়ের ছোটবড় যত প্রতিবন্ধকতার কথা।
১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট রাতে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী নিজে ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান— তিনি তাদের কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করবেন কিনা। ওয়াজেদ মিয়া জানান, হাসিনারা দুই বোন দেশ থেকে কেবল ২৫ ডলার করে সঙ্গে এনেছে। ওয়াজেদ মিয়া পরে রাষ্ট্রদূত চৌধুরীকে জানান, তাদেরকে একহাজার জার্মান মার্ক দিলেই চলবে। পরদিন ১৮ আগস্ট দূতাবাস থেকে দুপুরের আগে বাসায় ফিরে শেখ হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়াকে এই দিনই কার্লসরুয়েতে যাওয়ার এবং তার পরের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত করেন হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী। আলোচনার একপর্যায়ে তিনি শেখ হাসিনার হাতে এক হাজার জার্মান মার্ক তুলে দেন।
মধ্যাহ্নভোজের পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনা তাদের দুই সন্তান, শেখ রেহানাসহ কার্লসরুয়ে রওনা হন। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাদের জন্য দূতাবাসের একটি গাড়িরও ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি (চৌধুরী) জানান, তাদের জরুরি কাজগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা গাড়িটি সঙ্গে রাখতে পারবেন।
বন শহরে রাষ্ট্রদূত ‍হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর এই বাড়িতে তিন দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছবি: সংগৃহীতবন শহরে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর এই বাড়িতে তিন দিন ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ছবি: সংগৃহীত
রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন
ড. কামাল হোসেন বনে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর বাসায় ১৫ আগস্ট রাত যাপন করে ১৬ আগস্ট লন্ডনের উদ্দেশে রওনা হন। রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তার গাড়িতে করে তাকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। এর আগে তাকে (কামাল হোসেন) কোনও একটা বিবৃতি দেওয়ার কথা বলে রাজি করানো যায়নি। তিনি সংবাদ সম্মেলনেও যাননি। তবে ওয়াজেদ মিয়াও তাদের সঙ্গে বিমানবন্দরে যান।
বিমানবন্দর থেকে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে কার্লসরুয়েতে যেতে বলেন, তার প্রয়োজনীয় জরুরি জিনিসপত্র ও গবেষণা কাজে ব্যবহৃত বইপত্র নিয়ে আসার জন্য। সেই মতো ওয়াজেদ মিয়া কার্লসরুয়ে যান। কিন্তু ওই দিন শনিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় পরমাণু গবেষণাকেন্দ্র বন্ধ ছিল। ফলে তিনি তার প্রয়োজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। সন্ধ্যার কিছু পরেই তিনি বনে ফিরে আসেন।
ওয়াজেদ মিয়া কার্লসরুয়ে থেকে ফিরে আসার পর রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করেন তারিক এ করিমকে। তাকে বলা হয়, তিনি যেন তার গাড়িটি নিয়ে আসেন।
ফোন পেয়ে তারিক এ করিম তার গাড়ি নিয়ে আসেন। বেশ রাতে ওই গাড়িতে তার স্ত্রী ও ওয়াজেদ মিয়াকে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত এক স্থানে যান। তিনি নিজেই গাড়িটি চালান। পথে ওয়াজেদ মিয়াকে জানানো হয়, ওখানে ভারতীয় দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা গাড়ি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। ওই কর্মকর্তা তাকে ভারতের রাষ্ট্রদূতের কাছে নিয়ে যাবেন। তারা ভারতীয় কর্মকর্তার অবস্থানের কাছে ওয়াজেদ মিয়াকে নামিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। তিনি ইচ্ছা করেই তার সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেননি। তখন বঙ্গবন্ধুকন্যা ও পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা ছিল সবচেয়ে বড় ইস্যু।
সেদিন পূর্বনির্ধারিত স্থানে ওয়াজেদ মিয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তা সি ভি রঙ্গনাথন। ওয়াজেদ মিয়া তার গাড়িতে করে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসভবন অভিমুখে রওনা হন। ভারতের রাষ্ট্রদূত মহম্মদ আতাউর রহমানের বাসভবনের দিনটি স্মৃতিচারণা করে ওয়াজেদ মিয়া তার বইতে লিখেছেন:
‘অতঃপর ভারতীয় এই অফিসিয়ালের সঙ্গে আমি তাদের রাষ্ট্রদূতের বাসায় যাই। একটু ভয়ে ভয়ে আমাদের বিপর্যয়ের কথা আমি তাকে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি। আমার কথা শোনার পর তিনি আমাকে লিখে দিতে বলেন যে, আমরা ভারতীয় সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাই। অতঃপর তিনি একটি সাদা কাগজ ও কলম আমার হাতে তুলে দেন। তখন মানসিক দুশ্চিন্তা ও অজানা শঙ্কায় আমার হাত কাঁপছিল। যাহোক, অতি কষ্টে রেহানাসহ আমার পরিবারবর্গের নাম উল্লেখপূর্বক সবার পক্ষ থেকে আমি লিখলাম— শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয় ও শিশু মেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবল ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের কাছে কামনা করি রাজনৈতিক আশ্রয়।’
উল্লেখ্য, মহম্মদ আতাউর রহমান হাঙ্গেরিতে ভারতীয় দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স থাকাকালে সে দেশের তরুণ বিপ্লবীদের নানা সহযোগিতা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নির্দেশে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যাদের দুর্দিনে তিনিই আবার নেহরুকন্যার নির্দেশে তাদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছিলেন। ভারতে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ ও গোপনে জার্মানি ত্যাগের ঘটনায় নেপথ্যের কুশীলব ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আতাউর রহমান পশ্চিম জার্মানিতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। সূত্র : পদ্মাটাইমস