শনিবর, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:২৪ pm
ডেস্ক রির্পোট : হতভাগ্য কন্যা শিশুদের শিক্ষা প্রসার, স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাসহ সমাজ সচেতনতায় অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন চাঁদমনি অনাথ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল। তিনি ওই আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা।
উপজেলার চাওড়াডাঙ্গী গ্রামের রেলওয়ে কর্মকর্তা মৃত মোসলেম উদ্দিন আহমেদ ও মৃত পিয়ারা আহমেদের ঘরে ১৩ অক্টোবরে ১৯৪৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। অর্থনীতিতে অনার্স এবং এমএসএস পাশ করেন। কর্মময় জীবনে একজন সফল ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন।
উত্তরা ব্যাংকের এজিএম পদ থেকে ১৯৯৬ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন পিজিরুল আলম দুলাল। তারপর কিছু একটা করার জন্য বিবেক তাকে তাড়িত করে। চলে আসেন পৈতৃক ভিটায় ছায়া ঘেরা সবুজ পরিবেশে, যেখানে তার নাড়ি পুঁতে রাখাসহ আছে শৈশবের অফুরন্ত স্মৃতি।
তিনি ও তার সহধর্মিণী মোতাহারা বানু উপলব্ধি করতে থাকেন সমাজের কিছু অবহেলা,অনাদর, অসচেতনতা, ধর্মের লেবাসে প্রতারিত মানুষের কথা। ফলে অনেক ভাবনার পর এই নিঃসন্তান দম্পতি একদিন মনস্থির করে ফেলেন অবহেলিত পিতৃ-মাতৃহারা কন্যাশিশুদের নিয়ে কাজ করবেন।
১৯৯৭ সালে নীলফামারীর জলঢাকায় চাওড়াডাঙ্গী এলাকায় এক শুভক্ষণে অবহেলিত হতদরিদ্র ৫ জন কন্যাশিশু নিয়ে চাঁদমনি নামে একটি কন্যাশিশু আশ্রমের শুভ সূচনা করেন পিজিরুল আলম দুলাল দম্পতি। প্রতিষ্ঠানটি তার নিজ বাড়িতে হলেও বর্তমানে চাঁদমনি আশ্রমের মেয়েরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অধ্যয়নরত। অথচ চাঁদমনি আশ্রমটি এখানে প্রতিষ্ঠিত না হলে দেশের অনেক অবহেলিত এলাকার মতো কন্যা শিশুরা হয়তো অবহেলিত থেকে যেত। শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত হতো তারা। স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য সেলাইসহ বিভিন্ন হস্তশিল্প শেখা তাদের স্বপ্নই রয়ে যেত।
বর্তমানে চাঁদমনির নিজ অর্থায়নে পড়া লেখা করা কন্যা শিশুদের সংখ্যা ৩৬ জন। করোনা মহামারীতেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কন্যা শিশুদের লালন পালন করা হয়েছে আশ্রমে। কিছু ছাত্রী ছুটিতে বাড়ি গেলে তাদের অভিভাবক চুপিসারে তাদের বিয়ে দেন বলে জানান বলে চাঁদমনি প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম।
তিনি আরও বলেন, কন্যা শিশুদের লালন পালন করতে মানুষের রক্তচক্ষু দেখতে হয় ও অনেক কথা শুনতে হয়। তারপরেও অবহেলিত এ অঞ্চলে পিতৃমাতৃহীন কন্যা শিশুদের আশার আলোর ঠিকানা চাঁদমনি। এখানে পড়ালেখার পাশাপাশি পবিত্র কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব, সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র আছে। আশ্রিত অনাথ বালিকাদের দ্বারা অবসর সময়ে তৈরি হস্তশিল্প পণ্য প্রদর্শনীর জন্য দ্বি-বার্ষিক চাঁদমনি গ্রামীণ মেলার আয়োজন করা হয়।
এছাড়া উপজেলার কিছু হিন্দু পরিবারসহ হরিজন পল্লীর কন্যা শিশুরা চাঁদমনি থেকে নিয়মিত পড়ালেখার যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে চাঁদমনি থেকে। শুধু তাই নয় অনেক মুসলিম ও হিন্দু পরিবারের কন্যা শিশুরা চাঁদমনির অনাবাসিক হলেও তারা শিক্ষা, বস্ত্র ইত্যাদি সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
পিজিরুল আমল ১৯৯৫ সালে পবিত্র হজব্রত পালন করেন। তিনি নারী শিক্ষা অগ্রদূত মহীয়সী রমণী বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসার আদর্শে অনুপ্রাণিত বলে জানান। তিনি অনেকটা আক্ষেপ নিয়ে সাংবাদিকদের জানান, দিন বদলেছে। এখানে আশ্রিত মেয়েদের বাবা-মা নিয়ে গিয়ে বাল্যবিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মেয়েরা বেড়াতে গেলে অনেকে আসে না। পরে জানতে পারি তার বিয়ে হয়ে গেছে। এলাকায় তাকে চাঁদমামা বলে অনেক শিশুই ডাকে। ডাকটি মধুর হলেও ব্যক্তিগত জীবনে একেবারেই আশ্রয়হীন, দাম্পত্য জীবনে তারা চাঁদমনির চাঁদমাখা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে সন্তানহীন অনুভূতিগুলো তাদের কখনো দাগ কাটে না।
চাঁদমনিতে প্রবেশ করলেই চোখে পড়বে চিরায়ত বাংলার হারিয়ে যাওয়া কিছু উপকরণের নমুনা। গরুরগাড়ি, পালকি, ঢেঁকিসহ ১৯৭১ সালের গণহত্যার জলঢাকা কালীগঞ্জ বধ্যভূমির শহিদদের তালিকা ইত্যাদি।
এখানে পিজিরুল আলম নিজেই শিশুদের প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পড়ালেখার তদারকি করে থাকেন। বিনোদনের জন্য আশ্রমটির ভিতরে খেলার ব্যবস্থা কবিতা আবৃতি ও সংগীতের জন্য রয়েছে বাদ্যযন্ত্র। এখানে একটি গোলঘর আছে- সেখানে কন্যারা গান, কবিতা, নৃত্য পরিবেশন করে।
এখানকার কন্যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করাসহ অনেকেই সংসার জীবনে চলে গেছেন। বর্তমানে অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী মনা জানান, আমি পঞ্চম শ্রেণিতে থাকাকালীন সময়ে চাঁদমনিতে এসেছি। আজ মামার (পিজিরুল আলম দুলাল) সহযোগিতায় এখন আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছি। ওই সময় মামা আশ্রয় না দিলে আমার ভবিষ্যৎ কী হতো আমি জানি না।
মনার মতোই রিথিনা, পিংকি, ফেরদৌসি এরা সবাই এ আশ্রমে থেকেই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে চলছে। পিজিরুল আলম দুলাল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন কুসংস্কারের আশ্রমে থাকা অন্ধকারকে আলোকিত করার জন্য নিরলস তার লক্ষ্য অব্যাহত রেখেছেন। এসব করতে গিয়ে তার চাকরি জীবনের অবসরকালীন টাকা, পৈতৃক সম্পত্তি সবই ফুরিয়েছেন। বর্তমানে তার কিছু আত্মীয়-স্বজন, চাকরি জীবনের সহকর্মী ও কিছু দানশীল ব্যক্তির সহায়তায় চাঁদমনি প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চলছে।
এছাড়া নিয়মিত যারা সাহায্য করে থাকেন তাদের মধ্যে বোন মাসুদা বেগম ও ভগিনীপতি আব্দুল কাদের অন্যতম। এখন তিনি বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও তার কর্ম-উদ্দীপনার অভাব নেই। হতভাগ্য কন্যা সন্তানের জন্য অবিরত কাজ করে যাচ্ছেন।
এ নিয়ে পিজিরুল আলম দুলাল বলেন, কথার ফুলঝুড়ি নয়, কাজ করতে হবে। উদারভাবে সমাজ সেবায় এগিয়ে আসলে অভাব, কষ্ট, অবশ্যই লাঘব হবে। আমাদের দিন একদিন বদল হবেই।
সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতির বিশ্বাসী ও আধুনিক স্বপ্নের বাস্তবায়নকারী পিজিরুল আলম। এলাকার অনাথ কন্যা শিশুসহ সবার সঙ্গে তার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। তার মতো আরও ১০ জন এগিয়ে আসলে দেশের ভাবমূর্তি বিশ্ব দরবারে আরও ব্যাপকতা পাবে।
চাঁদমনি সম্পর্কে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুব হাসান জানান, সমাজের অবহেলিত এবং পিছিয়ে পড়া কন্যা শিশুদের খুঁজে বের করে আলোকিত করছেন চাঁদমনির প্রতিষ্ঠাতা পিজিরুল আলম দুলাল। তার এই মহৎ কাজকে আমি শ্রদ্ধা জানাই। সমাজের প্রতিটি এলাকায় নারী শিক্ষায় পিজিরুল আলম দুলালের মতো মানুষেরা এগিয়ে আসবেন- চাঁদমনি তার দৃষ্টান্ত। সূত্র : যুগান্তর