শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:১৯ pm
ডেস্ক রির্পোট : ছোটবেলা থেকেই অভাবের সংসারে বেড়ে উঠেছেন রুবেল হোসেন (২৬)। স্বপ্ন ছিল সেনা কর্মকর্তা হয়ে দেশের সেবা করার। কিন্তু দারিদ্র্যতার কারণে সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি তার। কিশোর বয়স থেকেই কখনো দিনমজুরি আবার কখনো ভ্যান চালিয়ে যাচ্ছেন। পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। প্রাথমিকে বৃত্তি পাওয়া এই মেধাবী যুবক এখন পুরোদস্তুর ভ্যানচালক। পাশাপাশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্সে পড়ছেন।
ভ্যানগাড়ির প্যাডেল আর বইয়ের পাতা ওল্টানো রুবেল তুচ্ছতাচ্ছিল্য, লজ্জা, সংকোচ সবকিছুকে পেছনে ফেলে আপন আলোয় এগিয়ে চলেছেন। একটু সম্মানের সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানোর জন্য বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে চাকরির আবেদন করেও দিনশেষে তাকে হতে হয়েছে হতাশ! শিক্ষিত এই যুবকের পরিচয় এখন ভ্যানচালক; যা এখন তার পেশায় পরিণত হতে চলেছে!
পাবনার চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা পশ্চিমপাড়া গ্রামের কাজিম উদ্দিন এবং রঙ্গজান বেগম দম্পতির ছোট ছেলে সংগ্রামী রুবেলের চোখে-মুখে স্পষ্ট ক্লান্তির ছাপ। পাওয়া না পাওয়ার দোলাচলে জীবনের বেশকিছু সময় অতিবাহিত হয়েছে। তবুও হাসিমুখে মেনে নিয়েছে জীবনের এই ধারাপাতকে। তবে ইচ্ছা শক্তি থাকলে কোনো বাধাই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না তার জ্বলন্ত উদাহারণ দেখালেন পাবনা সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রুবেল।
কোনো পেশা ছোট নয়, প্রয়োজনে বাকি জীবনটা ভ্যানগাড়ি চালিয়ে পার করে দেবেন এমন ইচ্ছা পোষণ করে রুবেল জানান, বাবা কাজিম উদ্দিন ছিলেন দিনমজুর। অন্যের দেওয়া জায়গায় টিনের ছাপড়া ঘরে বসবাস তাদের। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরমধ্যে বড়ভাই রতন হোসেন বিয়ে করে আলাদা বসবাস শুরু করেন। অসুস্থ বাবার চিকিৎসা এবং সংসারের হাল ধরতে গিয়ে পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম হয় রুবেলের।
উপায়ান্তর না পেয়ে কিশোর বয়সেই শুরু করেন দিনমজুরি। কিন্তু উপার্জন কম হওয়ায় অন্যের ভ্যান গাড়ি ভাড়া নিয়ে চালানো শুরু করেন। পাশপাপাশি শত বাধা সত্ত্বেও চালিয়ে যান পড়াশোনা। ২০১১ সালে ছাইকোলা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাশ করেন রুবেল। এরপর ছাইকোলা ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। এর মধ্যে দেখা দেয় অভাব। দিনরাত পরিশ্রম করতে গিয়ে পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটে।
এরপর ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। কিন্তু হাল ছাড়েননি রুবেল। ২০১৪ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাশ করেন তিনি। এরপর একই কলেজ থেকে ২০১৭ সালে স্নাতক পাশ করেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে পাবনা অ্যাডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি হন। এলাকার অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও সেগুলো কানে নেননি তিনি।
রুবেল বলেন, ভ্যানের চাকা ঘুরলে তবেই খাবার জোটে আমাদের পরিবারে। টাকার অভাবে নতুন ভ্যান কিনতে পারিনি। ভাড়া নিয়ে ভ্যানগাড়ি চালাই। অনেক সময় সময় খারাপ লাগে, যখন কোনো যাত্রী ভাড়া বা কোনো বিষয় নিয়ে গালাগাল করেন। চাকরির চেষ্টা করেছি অনেক কিন্তু হয়নি। আমার কপালে যা ছিল তাই হয়তো হয়েছে! তবে আমার বড় পরিচয়, আমি ‘ভ্যানচালক’! আমি তো চুরি করছি না। আমি আমার বাবা-মাকে সুখ দিতে না পারলেও কষ্টে তো রাখিনি। এটাই আমার বড় পাওয়া।
ইসাহক আলী নামে রুবেলের এক সহপাঠী যুগান্তরকে বলেন, আমাদের ব্যাচে রুবেলের মতো মেধাবী শিক্ষার্থী খুব কম-ই ছিল। ছোটবেলা থেকেই রুবেল অনেক সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম ওর পড়াশোনা হবে না! কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে এখন মাস্টার্সের ছাত্র। এখন যোগ্যতা অনুযায়ী রুবেলের একটা চাকরি হলে স্বস্তি পেতাম।
ছাইকোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান নুরুর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলাকার মধ্যে অত্যন্ত বিনয়ী ছেলে হিসেবে পরিচিত রুবেল। ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী সে। সংসারে অভাব না থাকলে হয়তো সে বড় কিছু করত। তবে শিক্ষিত একটা ছেলে হয়ে ভ্যান চালাচ্ছে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগে। তবে শত কষ্টের মাঝেও সে যা করে দেখিয়েছে বর্তমান সমাজে দৃষ্টান্ত। তার (রুবেল) যোগ্যতা অনুযায়ী একটা সম্মানজনক চাকরি হওয়া খুবই প্রয়োজন। সূত্র : যুগান্তর