শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:২০ am
পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন মানেই হলো বাঙালি ও বাংলাদেশের অস্তিত্ব প্রকাশের শুভ দিন। নতুন একটি অধ্যায়। জাতীয় চেতনা বিকাশের আরো একটি দিন। স্মরণীয় বরণীয় দিন। স্মৃতির মিনারে সাজিয়ে রাখার দিন। অর্থনৈতিক মুক্তির অনন্য দিন। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি আর যোগাযোগের অবিস্মরণীয় ও বিস্ময়ের দিন। মুক্তি সংগ্রাম-স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত দিন-বিজয় দিবস; ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর আলোয় প্রকাশিত যোগাযোগ ব্যবস্থার চূড়ান্ত প্রকাশে ও অর্থনৈতিক সাফল্য লাভে জীবন ও দেশ-জাতির শ্রেষ্ঠ দিন। ২৫ জুন ২০২২ খ্রিস্টাব্দ।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বললে যেমন ফিরে আসে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস। পূর্বাপর অনেক ঘটনা ও স্মৃতি অক্সিজেন হয়ে দেখা দেয়। আমরা কখনো একে এড়িয়ে যেতে পারি না। স্বাধীনতা হলো সেই সত্যের উচ্চারণ যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও জাতীয় জীবন অন্যের কাছে নির্ভর না করা শেখায়। মাথা উঁচু করে চোখের ওপর চোখ রেখে কথা বলতে উজ্জীবিত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালি ও বাংলাদেশকে যে ফিনিক্স পাখির মতো দেখতে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী বা পঞ্চাশ বছরে এসে অর্থনৈতিক মুক্তি ও যোগাযোগ অভিভাবক বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসিকতা ও ঋজুতার কারণে তা সম্ভব হয়েছে। এ যেন বাঙালির আগামী হাজার বছরে জয়ী হওয়া। বলা আবশ্যক নয় কি, জয়তু বাংলাদেশ।
অকপটে বলা প্রয়োজন, একদিনে কোন কিছু পাওয়া যায় না। কথায় আছে, যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় সে-ও মার্তৃগর্ভে থাকে দশ মাস। পদ্মা সেতু কোন কল্পনা বা স্বপ্ন নয়, নতুন এক বাস্তবতার নাম। ভালোবাসায় ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ করে নেয়া সোনালি আখরে জাতীয় জীবনে লেখা নাম- পদ্মা সেতু।
পদ্মা বহুমুখী সেতু এখন পদ্মা সেতু। এ সেতুর নির্মাণের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। ভালোবাসা ও ঘৃণার প্রকাশ। একাত্তরে যেমন ছিল পক্ষ-বিপক্ষ, পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম নয়। অনেক জল্পনা-কল্পনার পর ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। নতুনভাবে যাত্রা শুরু হয় বাঙালির। প্রথম দিকে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে নির্মাণ কাজ শুরুর কথা ছিল এবং তা সম্পন্ন করার কথা ছিল ২০০৪ সালের জুনের মধ্যে। জাতির ভাগ্যাকাশে বিড়ম্বনার বাতাস বয়। সে বার আর পদ্মা সেতু বাস্তবে হলো না। দৃশ্যমান হলো না স্বপ্নের পদ্মা সেতু। ফেরি-লঞ্চ-স্পিড বোট-নৌকা-ট্রলার হয়ে থাকলো যোগাযোগ অনুষঙ্গ। বঞ্চিত হলো দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্মৃত জনপদ- কুয়াকাটা, বেনাপোল স্থল বন্দরসহ একাধিক সমুদ্র বন্দর। নির্বিঘেœ যাওয়া গেলো না রাজনীতির তীর্থ-টুঙ্গিপাড়া, প্রাচীন বঙ্গের রাজধানী খ্যাত কোটালীপাড়া কিংবা ষাটগম্বুজ মসজিদ হয়ে জলবেষ্টিত তবু মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরবন।
সময়ের সিঁড়ি ধরে এগোয় বাংলাদেশ। থমকে থমকে কিছু পথ কথার ফানুসে পূর্ণ হয়। কাজীর গরু হিসেবে আছে, গোয়ালে নেই। বাস্তবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ২৯ শতাংশের বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু নিয়ে দু’টি সরকারের উদ্যোগ যখন ব্যর্থ তখন স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির জন্য এলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। সকল বিভেদ ঘুচিয়ে রেলপথ সংযুক্ত করে ২০১১ সালের ১১ জুন প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। দ্বিতল বিশিষ্ট পদ্মা সেতু সিটল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের সেতুর উপরে ৪ লেনের সড়ক পথ ও নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ। এ ব্রিজের মাধ্যমে এপার থেকে ওপারে যাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ-ফাইবার অপটিক ক্যাবল। সম্প্রসারিত হবে বিজ্ঞানময় আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার।
পদ্মা ব্রিজের নকশা করে এইসিওএম। আর এটি নির্মাণ করে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। এ ব্রিজ নির্মাণে প্রখ্যাত স্থপতি অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১ সদস্য বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞ প্যানেল কাজ করে। আমাদের অর্থ, আমাদের সেনাবাহিনী, আমাদের লোকবল এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ যুক্ত হয় এ ব্রিজে। ব্রিজের জন্য ৯১৮ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করে সরকার। যারা নিজেদের ভিটা-মাটি ত্যাগ করেছে দেশের জন্য, তাদের জন্য সরকার শুধু আবাসন কিংবা ক্ষতিপূরণ প্রদান করেন নি, বরং ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক জনগণকে সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধা প্রদান করেছেন। স্কুল-মসজিদ, খেলার মাঠ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, নিরাপত্তার জন্য থানা পর্যন্ত স্থাপন করা হয়েছে। পদ্মা ব্রিজকে কেন্দ্র করে পদ্মা উত্তর ও পদ্মা দক্ষিণ নামে দু’টি থানা গঠন করা হয়েছে। যথেষ্ট নিরাপত্তার জন্য শেখ রাসেল সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রশ্ন করা হচ্ছে, ২০১৪ সালের নভেম্বরে যে ব্রিজটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন, তার ব্যয় ৩০,১৯৩ কোটি? ৬.১৫ কি.সি. বা ২০,২০০ ফুট দীর্ঘ ও ১৮ মিটার বা ৩৯.৪ ফুট প্রস্থের ব্রিজে এত টাকা ব্যয়! এসব প্রশ্নের জবাব অনেকের জানা। প্রশ্ন করা, না করা, জবাব দেয়া কিংবা না দেয়ার মধ্যে অনেককিছু থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, দুর্নীতির অভিযোগ খারিজ হয়েছে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্যোন্নয়নে ব্যর্থ হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার জাতীয় প্রয়োজনে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। যারা প্রশ্ন করে সময়ক্ষেপণ করতে চায় তারা এও বলে, ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রথম স্প্যান বসালো আর ৪১ তম বা শেষ স্প্যানটি বসালো ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর। এই দীর্ঘ সূত্রতা কী বাজেট বাড়াবার কৌশল নয় ? অনেকে জবাব দেয়, কাজ করলে কিছু সময়ের দরকার। কাজ বুঝে সময়। ব্রিজ উদ্বোধনের প্রাক্কালে টোল নিয়েও প্রশ্ন তোলে কেউ কেউ। কেন ফেরি পারাপারের থেকে খরচ বেশি পড়বে ? অনেকে জবাব দেয়, অর্থ-বিভাগের সঙ্গে সেতু নির্মাণে ২৯,৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এসব তুচ্ছ প্রশ্ন থেকে সরে এসে কেউ কেউ বলে, দক্ষিণের এলাকা কিংবা ২৯ শতাংশ এলাকার উন্নয়ন নয়, সমগ্র দেশ অর্থনীতির সূচকে এগিয়ে যাবে। জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
সমালোচনার কিংবা, বিরোধিতার মধ্য থেকে শেখ মুজিব জাতির অভিভাবক-জাতির পিতা হয়েছিলেন, আর শেখ হাসিনা যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। তিনিও স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে সমালোচনা ও বিরোধিতার জবাব দিচ্ছেন কখনো কথায় কখনো বা কাজে। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও বিষয়টি স্পষ্ট। তিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। কিছু পথ পিচ্ছিল ছিল। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন না। আবর যখন ফিরে এলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হয়ে তখন জাতীয় সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মূল অবকাঠামো উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে উন্মুক্ত করে দেন বঙ্গবন্ধু কন্য আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার ভিত্তি প্রস্তরের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হতে থাকে। বাস্তবে রূপ পায় আবার। তিনিই খুলে দিলেন সেতুটি ব্যবহারের জন্য। দীর্ঘ পথের এই সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তির আকাঙ্খার আরো একধাপ অগ্রগতি। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা পদ্মা সেতু ব্যবহারের মাধ্যমেও নির্মিত হবে। যুগপৎ মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রাণে প্রাণে সঞ্চারিত হচ্ছে এবং হবে। শতবর্ষের অধিক সময়ের জন্য নির্মিত পদ্মা সেতু আলোর পথ দেখাবে। বিশে^ নবতর উচ্চতায় দাঁড়াবে লাল সবুজে খচিত বাংলাদেশ। এমন প্রেক্ষিতে ছড়ার পংক্তি দিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের মনভাব প্রকাশ করা যায়। “পদ্মা সেতু” ছড়ায় চয়ন করা হয়েছে-
লাল সবুজের স্বাধীন দেশে
জয়ের মালা আঁকে-
শিশুর সাথী ফুল পাখিরা
পদ্মা সেতুর বাঁকে।
তোমার আমার ভালোবাসা
বাংলাদেশের জন্য
অর্থনীতির ঘুরবে চাকা
ঘুচবে দেশের দৈন্য।
জগত জুড়ে সব মানুষে
ফিরে এসে বাংলায়
গল্প ছড়ায় হাজার কথা
মনটা ভরে পায়।
তাইতো আমি পদ্মা সেতুর
উদ্বোধনের দিন
স্মৃতির মিনার সাজিয়ে রাখি
বাজাই মুক্তিবীন।
লেখক : খান চমন-ই-এলাহী, কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও অ্যাডভোকেট। সূত্র : এফএনএস