শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ১০:৫৯ am
ডেস্ক রির্পোট : নাটোরের বাগাতিপাড়ায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) পুনঃখনন করা বারুইপাড়া খালের উত্তোলনকৃত সরকারি মাটি উধাও হয়ে যাচ্ছে।
খাল খননের পর পরই এলাকায় এস্কেভেটর বসিয়ে খালের একপাড়ের উত্তোলিত মাটি প্রায় প্রতিদিনই কে বা কারা ট্রাক্টরে করে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দপ্তর স্থানীয় প্রশাসন সহ পুলিশকে বিষয়টি অবগত করে লিখিত পত্র দিয়েই দায়মুক্ত থাকার চেষ্টা করেছেন। তবে মাটি পরিবহন বন্ধ করার জন্য পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয় বলে দাবী সংশ্লিষ্ট দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তার।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানাযায়, ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নাটোর জেলা সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বাগাতিপাড়া উপজেলার বারুইপাড়া খাল পুনঃখনন করে।
উপজেলার বড়পুকুরিয়া রেললাইন ব্রিজ হতে বাগাতিপাড়া পৌর ভুমি অফিস পর্যন্ত ১ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এই খাল পুনঃখননে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। গত ১২ এপ্রিল এই খাল পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল। এই খাল খননের কারনে এলাকার প্রায় ১৫০ হেক্টর জমি সেচ সুবিধা পাবে। উপকার ভোগী প্রায় ৩০০ কৃষক ভুগর্ভস্থ পানি ব্যবহার না করেই ভু-পৃষ্ঠস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ সুবিধা পাবে।
খালের দু’ধারের কৃষক এই খালের পানি সেচ সুবিধা পাবে। এতে করে এলাকার প্রান্তিক কৃষকের বোরোসহ আমন আবাদ নিশ্চিত হবে।
এদিকে ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে এই খাল পুনঃখননের সময় খালের তলদেশ থেকে উত্তোলনকৃত মাটি খালের দুপাড়ে রাখা হয়। কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পরই কতিপয় ব্যক্তি উত্তোলনকৃত খালের একপাড়ের মাটি ট্রাক্টরের মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে। এসব উত্তেলনকৃত মাটি এস্কেভেটর মেসিন দিয়ে ট্রাক্টর ভর্তি করে অজানা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এলাকাবাসীরা জানায়,এলাকার মসজিদ, কবরস্থান,মাদ্রাসা,মন্দির ও স্কুল কলেজের নাম করে এসব সরকারি মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির দিকে আঙ্গুল তুলেছেন এলাকাবাসীদের কেউ কেউ।
তাদের অভিযোগ আব্দুল গণি নামে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশ্যে এসব মাটি নিয়ে যাওয়া হলেও তা বন্ধের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি কাউকে। তবে পুলিশের দাবী বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাৎক্ষনিক এসব মাটি পরিবহন বন্ধ করা হয়।
সরেজমিন ঘটনাস্থলে গেলে,কয়েকজন মটি ক্রেতা জানান,বাড়ি করার সময় মাটির প্রয়োজন হওয়ায় তারা প্রতি ট্রাক্টর মাটি ৭ শত থেকে ১ হাজার টাকায় কিনে নিচ্ছেন।
রমিছা বেগম নামে এক মহিলা বলেন, মাটি কেনার জন্য তিনি এখানে এসেছেন। যারা এখানকার মাটি বিক্রি করছেন তারা এক ট্রাক্টর মাটির দাম হাকাচ্ছেন ৮ শত থেকে ১ হাজার টাকা। ওই মহিলার কাছে মাটি বিক্রেতার নাম জানতে চাইলে তিনি মাটি বিক্রেতার নাম-পরিচয় জানাতে পারেননি। তবে এস্কেভেটর ও ট্রাক্টর চালকরা মাটির চুক্তি করে ক্রেতার ঠিকানা অনুযাযী মাটি পৌঁছে দেয় বলে জানান তিনি।
খালের পাড়ে মাটি সরানের কাজে নিয়োজিত ইয়াকুব নামে এক শ্রমিকের কাছে মাটি কোথায় যাচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তিনি জানান, এলাকার এমপির সাথে কথা বলে মাটিগুলো বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে শুনেছেন।
স্থানীয় কৃষক মোতালেব আলী বলেন, সরকারি এই খাল পুনঃখনন এর ফলে আমাদের জমিতে যেমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে না,তেমনি খরা মৌসুমে এই খালে সংরক্ষিত পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করতে পারবেন। তবে মাটি কেথায় যাচ্ছে বলতে পারবেননা। পুলিশ এসব মাটি নেয়া বন্ধ করেছিল। কিন্তু একদিন বন্ধ থাকার পর তা আবার চালু হয়েছে।
তবে খাল থেকে উত্তোলনকৃত মাটি জমিতে ফেলা নিয়ে স্থানীয় কৃষকদের অনেকেই প্রতিবাদ করেছেন। কৃষক ইয়াসিন মন্ডল বলেন, বিলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া খালটি পুন:খননের কারনে আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। কিন্তু খননের মাটি খাল তীরের জমিতে ফেলায় তাদের পারাপারে সমস্যা হচ্ছে। তবে পারাপারের জন্য একটি কালভার্ট নির্মিত হলে তাদের আরও উপকার হবে।
এস্কেভেটর চালক ইব্রাহিম আলী জানান, প্রতিদিন প্রায় ১০০ ট্রাক্টর মাটি ভর্তি করা হয়। মাটি কার নির্দেশে এবং কোথায় যাচ্ছে জানতে চাওয়া হলে তার নাম ঠিকানা জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
এস্কেভেটর চালকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরিসংখ্যন অনুযায়ী গত এক মাসে ৩ হাজার ট্রাক্টর মাটি বিক্রি করা হয়েছে। এক ট্রাক্টর মাটির দাম সর্বনিম্ন ৭ শ টাকা হলে মাটি বিক্রির প্রায় ২১ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রভাবশালীরা।
বাগাতিপাড়া পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল গনি মাটি বিক্রির সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের খাল খননের মাটি মানুষের জমির উপর রাখা হয়েছে। জমি মালিকরা তাদের জমির উপর মাটি রাখতে দেবেনা।
এছাড়া স্থানীয় এমপি মহোদয়ের মৌখিক অনুমতি সাপেক্ষে ওই মাটি এলাকার বিভিন্ন কবরস্থানসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ট্রাক্টর ও ভেকু মেশিনের খরচ উত্তোলনের জন্য কিছু জায়গায় এই মাটি বিক্রি করা হয়েছে। ট্রাক্টর চালকরাই কিছু মাটি বিক্রি করে তাদের খরচ নিয়েছে।
বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) নাটোর জোনের সহকারী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আহসানুল করিম বলেন, ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে নাটোর জেলা সেচ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) বাগাতিপাড়া উপজেলার বারুইপাড়া খাল পুনঃখনন করা হয়।
ওই প্রকল্প চলমান রয়েছে। কিন্ত খাল পুনঃখননের উত্তোলনকৃত মাটি এলাকার কিছু কতিপয় ব্যক্তি উত্তোলনকৃত খালের একপাড়ের মাটি জোর পুর্বক ট্রাক্টরের মাধ্যমে নিয়ে যাচ্ছে।
এবিষয়ে অবগতি করা সহ সরকারি সম্পদ রক্ষার নিমিত্তে খালের মাটি যাতে কেউ নিয়ে যেতে না পারে সেজন্য আইনগত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবরে গত ১৮ এপ্রিল একটি লিখিত পত্র দেয়া হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসক, সংশ্লিষ্ট উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান,বাগাতিপাড়া থানার ওসি,সহকারী কমিশনার(ভুমি) এবং এিমডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক ,ইআইএনডি বিএমডি রাজশাহী বরাবরে অনুলিপি প্রেরন করা হয়। কিন্তু কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
এছাড়া যারা মাটি বিক্রি বা বহন করছেন তারা বরেন্দ্র বহুমুখি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। তাদেরকে একাধিকবার উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কর্নপাত না করে জোর করে মাটি নিয়ে যাওয়া হয়।
বাগাতিপাড়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ওহিদুল ইসলাম গকুল জানান, তিনি বারুইপাড়া খাল খননের উত্তোলনকৃত মাটি নিয়ে যাওয়ার বিষয় কিছুই জানেননা। এছাড়া বিষয়টি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যাপার। জোর করে কেউ মাটি নিয়ে গেলে উপজেলা প্রশাসন বা পুলিশের সহায়তা নিতে পারেন তারা।
বাগাতিপাড়া থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান, বিষয়টি জানার পর পরই সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে অবৈধভাবে ট্রাক্টরে করে মাটি বহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। এসময় এলাকার মানুষ তাদের জমিতে রাখা কিছু মাটি ধমীয় প্রতিষ্ঠানে দেয়ার কথা বলেন।
বাগাতিপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার প্রিয়াংকা দেবী পাল বলেন,বিষয়টি বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিজস্ব। জোরপুর্বক মাটি নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রশাসনিক কোন সহায়তা চাওয়া হয়নি উপজেলা প্রশাসনের কাছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুলের সাথে মোবাইল ফোনে এবিষয়ে জানতে যোগাযোগ তিনি বলেন, ওই খাল পুনঃখনন কাজের উদ্বোধন শেষে এলাকার কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে উত্তোলনকৃত মাটির জন্য আমাকে বলেন।
ধমীয় প্রতিষ্ঠানে মাটির জন্য ইউএনওর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে নেওয়ার পরামর্শ দিই। কেউ আমার নাম ব্যবহার করে বা জোর করে সরকারি মাটি নিয়ে গিয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। সূত্র : পদ্মাটাইমস