সমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৮:২৪ pm
আব্দুস সবুর, ভ্রাম্যমান প্রতিবেদক : কে দালাল কে কর্মকর্তা আর কে কর্মচারী বলা কষ্টকর। দিনের দিন দালালের সংখ্যা বাড়তেই আছে। হরেক রকমের দালাল দখল করেছেন ভূমি তহসিল অফিস গুলো। মাঝে মাঝে মক্কেলদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নিতে কর্মকর্তাদের পাশের চেয়ার নিয়ে দেদারসে কাজ করছে ভূমি দালালরা।
রাজশাহীর তানোর উপজেলার ভূমি অফিস ও তহসিল অফিসের এই অবস্থা। কোন নতুন মুখ অফিসে কাজের জন্য এসে পড়ছেন দালালদের খপ্পরে। এতে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন অনেকে। এক সার্ভেয়ারের ঘুষ নেওয়ার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বদলি হলেও কমেনি দালালদের উৎপাত। প্রকাশ্যে ওপেন ঘুষ বানিজ্য চলছে। এযেন তাদের প্রাপ্প। কোন ছাড় নেই টাকা দাও কাজ বুঝে নাও। টাকা ছাড়া ভূমি দপ্তরের কোন ফাইল নড়াচড়া করেনা। যেন তারা ঘুষ বানিজ্যের ট্রেনিং নিয়ে চাকুরীতে যোগদান করেছেন। পিয়ন মাস্টার রুল কর্মচারী সবাইকে দিতে হয় টাকা। নিয়মে পরিনত হয়ে পড়েছে। নাম জারি, আবেদন খতিয়ান উত্তোলন, দুই নম্বর কাজ এক নম্বরে নিয়ে আসা মিস কেস। সবকিছুই ভুমি অফিসে সম্ভব যদি দেওয়া হয় চাহিদা মত উৎকোচ।
ভুক্তভোগীদের পরিবার থেকে জানা গেছে, উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত তানোর উপজেলা। তানোর সদরে উপজেলা ভুমি অফিস। তানোর পৌরসভা, তালন্দ, সরনজাই এবং চান্দুড়িয়া ইউপির জন্য তহসিল অফিস পৌর এলাকার আমশো মহল্লায়। এখানে তহসিলদার রয়েছেন লুৎফর রহমান। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে এই উপজেলার বিভিন্ন তহসিল অফিসে পিয়ন থেকে তহসিলদার পদে কাজ করেছেন। এজন্য ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছেন সবার কাছে। অভিজ্ঞ কর্মকর্তা কিভাবে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে হয় সবই তার জানা। গড়েছেন পাহাড় সমান সম্পদ। তার অন্যতম দালাল পৌর এলাকার জিওল গ্রামের ইয়াকুব হাজী।
এই ইয়াকুবের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা ঘুষ বানিজ্য করেন লুৎফর এমন অভিযোগ হাজারো মানুষের । অবশ্য এই তহসিলদার অফিসে লিখে রেখেছেন আমি হার্টের রোগী বেশি কথা বলা যাবে না। তার আরেক দালাল সরনজাই ইউপির মুহুরী আলামিন ও তার পিতা সিদ্দিক। তাদেরকে কালিগন্জ হাটের সরকারি জায়গায় বিশাল মার্কেট করার জন্য জায়গা নির্ধারণ করে দেন। এঘটনায় অন্য ব্যবসায়ীরা মার্কেট বন্ধের জন্য বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েও আটকাতে পারেনি নির্মাণ কাজ ।
সম্প্রতি ২৯ মে ওই মার্কেট নির্মাণ বন্ধ ও উচ্ছেদের জন্য সরনজাই কাচারিপাড়া গ্রামের মৃত ইয়ানুস আলী মোল্লার পুত্র সিদ্দিক মোল্লা তার ছেলে আলামিন মোল্লাকে অভিযুক্ত করে এবার কালিগন্জ হাট রক্ষা কমিটির পক্ষে সভাপতি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব মোবারক আলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
এর অনুলিপি সচিব ভুমি মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, অফিসার ইনচার্জ ওসি এবং সহকারী কমিশনার ভুমি বরাবর দেওয়া হয়েছে ।
কামারগাঁ বাজারে তহসিল অফিসের তহসিলদার সাত্তার আব্দুস। তিনিও এক যুগ ধরে এ উপজেলায় কর্মরত। এরআগে তিনি মুন্ডুমালা বাজারের তহসিল অফিসের দায়িত্বে ছিলেন। নানা অনিয়ম দুর্নীতির জন্য তাকে কামারগাঁ ভূমি অফিসে বদলি করলেও বন্ধ হয়নি ঘুষ বানিজ্য। কলমা ইউপির দরগাডাঙ্গা তহসিল অফিসের তহসিলদার মিজানুর রহমান। তিনিও মুন্ডুমালায় দায়িত্বে থাকাকালীন প্রচুর অনিয়ম দুর্নীতির মাধ্যমে কাড়িকাড়ি টাকা লুটে নিয়েছেন। পুনরায় ওই অফিসের মধু গিলতে তদবির করেও ব্যর্থ হন। থাকতে হয় দরগাডাঙ্গায়। সেখানেও দেদারসে চালিয়ে যাচ্ছেন ঘুষ বানিজ্য। কিন্তু চলতি জুন মাসের ১ তারিখ নগরীর বোয়ালিয়া ভুমি অফিসে তার বদলি অর্ডার হয়।
উপজেলা পরিষদে ভূমি অফিস। অফিসের সার্ভেয়ার সদ্য বদলি হওয়া পুলক কুমার অপেন ঘুষ বানিজ্যের কারণে শাস্তি মুলুক বদলি হন। কিন্তু রয়ে গেছে নাজির শাহিনুর রহমান। নতুন সার্ভেয়ার, নাজির ও কানুনগো থেকে শুরু করে সকলেই ঘুষ বানিজ্যে লিপ্ত। তারা তো টাকা ছাড়া কোন ফাইলে সাক্ষর করেন না এমন অভিযোগ অহরহ। বিশেষ করে নাজিরের দূর্নীতির কারনে চরম অতিষ্ঠ জনসাধারণ। তিনি শহরের নওদাপাড়ায় জায়গাসহ পাহাড় সমান সম্পদ যা নাকি তদন্ত করলেই ধরা পড়বে। তার বাড়ি গোদাগাড়ী উপজেলার আলোকচত্র গ্রামে। ভূমি অফিসে চাকুরির সুবাদে অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। এসব কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় নতুন নতুন দালাল তৈরি হয়েছে। এমনকি কে দালাল কে কর্মচারী বলাই কষ্টকর।
তহসিলদার লুৎফর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ইয়াকুব কর্মকর্তা না কর্মচারী তিনি জানান, অফিসের কেউ নয়। তাহলে আপনি ভূমি অফিসের চেয়ারে বসে কিভাবে কাজ করেন এবং অতীতে তার কাছে অফিসের ফাইলপত্র থাকার কারনে ছয় মাসের জেল হয়েছিল। তাহলে আবার কেন প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি জানান, আমার অজান্তে হতে পারে । যেখানেই অভিযানে লুৎফর, সেখানেই ইয়াকুব হাজী। বাইকে দাবিয়ে অভিযান পরিচালনা করেন । বিগত কয়েক বছরের দালাল ইয়াকুব কাড়িকাড়ি টাকার মালিক বনে গেছেন। পৌর এলাকার আমান হিমাগার সংলগ্ন জমিও কিনেছেন। শুধু ইয়াকুব না কালিগন্জ হাটের কোটি টাকা মুল্যের জায়গায় মার্কেট নির্মাণ করেছেন সরনজাই ইউপির ভূমি দালাল সিদ্দিক ও তার ছেলে আলামিন। যারাই ভুমি তহসিল অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছেন রাতারাতি তাদের ভাগ্য বদল হয়েছে। নব্যনব্য দালালে ভরা এখন ভুমি অফিস।
বেশকিছু ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জমির জন্য মক্কেলের কাছ থেকে টাকা আদায় করা খুবই সহজ। জমির জন্য চাহিদা মতই টাকা পাওয়া যায়। জমির কাগজপত্র অনেকেই বোঝে না। এই উপজেলায় জমিদারের ভিপি ও খাস এবং রিসিভারেরও জমি রয়েছে বেশি। এমনো অভিযোগ আছে জমির মালিক পরিবর্তন হয়ে গেছে কিন্তু জানেই না। খাজনার চেক কাটার সময় পড়ে ধরা। তখনই চলে উভয় পক্ষের সাথে লেনদেনের হিসাব।
কালিগন্জ হাটের কোটি টাকা মুল্যের মার্কেট নির্মাণ বন্ধের অভিযোগ কারীর পক্ষে রক্ষা
কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মোবারক আলী জানান, ওই জায়গায় দীর্ঘদিন আগে আরেকজন ব্যক্তি মার্কেট নির্মাণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কিন্তু সিদ্দিক কিভাবে মার্কেট নির্মাণ করে। আমরা শুরু থেকেই নিষেধ করি। কিন্তু কোন কিছুর তোয়াক্কা করছেন সিদ্দিক। আগামী শুক্রবার মার্কেট উচ্ছেদের জন্য মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হয়েছে।
মার্কেট নির্মাণকারী মুহুরী সিদ্দিক মোল্লা জানান, মার্কেট নির্মাণ শেষ হয়ে গেছে। তারা আমার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছিল না দেওয়ার কারনে অভিযোগ দিয়েছে।
তানোর সদর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের তহসিলদার লুৎফর রহমানের ০১৭১৩- ৭০২৯৮৪ নম্বর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও রিসিভ হয়নি। এই তহসিলদার লুৎফর রহমানের কারিশমায় সিদ্দিক মুহুরী মার্কেট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এব্যাপারে সহকারী কমিশনার ভুমি স্বীকৃতি প্রামানিকের ০১৭১৬- ১৪৫৪১৪ নম্বর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনিও রিসিভ করেন নি।
এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) পংকজ চন্দ্র দেবনাথ জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য সার্ভেয়ারকে পাঠানো হয়েছিল। এখনও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তদন্তে সরকারি জায়গা হলে আইনগত ব্যবস্থা। আর নিজের হলে তো কিছুই করার নেই বলে ইউএনও। আজকের তানোর