শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৬:৪৯ am
জন্ম-মৃত্য-বিয়ে সৃষ্টিকর্তার হাতে। তবুও যে কোনো মৃত্যু বেদনাদায়ক। অকালমৃত্যু কখনওই কাম্য নয়। তারপরও প্রতিনিয়ত ঝরছে প্রাণ। প্রাকৃতিক কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ।
তেমনি একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এটি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল। অন্য যে কোনো দুর্যোগের চেয়ে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০১১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এক দশকে মোট ২ হাজার ৭৮৫ জনের বজ্রপাতে মৃত্যু হয়। আর আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্যে, বজ্রপাতের কারণে বছরে গড়ে দেড় শতাধিক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের তথ্যে, চলতি এপ্রিলের ২০ তারিখ পর্যন্ত বজ্রপাতে ২০ জনের মৃত্যু হয়।
২০২০ সাল থেকে দেশে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা দিয়েছে। সাধারণত এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর মাস হিসাবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বজ্রপাত হয়। কিন্তু ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেই বজ্রপাতে মারা গেছে কমপক্ষে ৭০ জন। যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ। গত বছরের ৬ জুন রোববার বজ্রপাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৭ জন মারা গেছেন।
সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডার স্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের তথ্য মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল- এ চার মাসে বজ্রপাতে সারাদেশে ৭৯ জনের প্রাণহানি ঘটে। সাধারণত জানুয়ারি মাসে শীত থাকায় এ মাসে বজ্রপাত হয় না। তবে সে বছর জানুয়ারি মাসেও বজ্রপাতে নিহত হয়েছে ৩ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও মার্চ মাসে ৬ জন এবং এপ্রিল মাসে ৭০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এপ্রিল মাসে মোট নিহত হয়েছেন ৭০ জন। সবচেয়ে বেশি ৪০ জন নিহত হয়েছে কৃষি কাজ করার সময়।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তন, লম্বা গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, আকাশে কালো মেঘের পরিমাণ ও মেঘে মেঘে ঘর্ষণের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বজ্রপাত। তাপমাত্রা যত বাড়বে বজ্রপাতও ততো বাড়বে। তাপমাত্রা গড়ে এক ডিগ্রি বেড়ে গেলে বজ্রপাত ১০ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ইদানীং মেঘে মেঘে ঘর্ষণের ফলে বা ঘন কালো মেঘের ওপরের ও নিচের অংশ দুটি পুল হিসেবে প্রবাহিত হয়। এই কারণে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কালো মেঘের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে বজ্রপাতের পরিমাণ। বিদ্যুৎপ্রবাহ মানুষের শরীর দিয়ে প্রবাহিত হয় অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতো। বিদ্যুৎ প্রবাহিত হলে মানুষ যেভাবে দ্রুত শক্ড হয়, ঠিক একইভাবে বজ্রপাতেও মানুষ শক্ড হয়ে মারা যায়। কারণ মানুষের শরীর বিদ্যুৎ পরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। যদি কোনো খোলা স্থানে বজ্রপাত হওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ পরিবাহী পদার্থ না-থাকে আর সেখানে যদি মানুষ থাকে যার উচ্চতা অন্য বিদ্যুৎ পরিবাহীর চেয়ে বেশি তাহলে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। সরাসরি মাটিতে সাধারণত বজ্রপাত হয় না। বজ্র বিদ্যুৎ পরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর ওই পরিবাহীর মাধ্যমে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। উঁচু গাছ, ভবন, পাহাড়ের শীর্ষে সাধারণত বজ্রপাত হয়। বাসাবাড়িতে লাগানো বজ্রপাত নিরোধক দ-ের ওপরও বজ্রপাত হয়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রায় সব জেলায় বজ্রপাত ঘটছে। বজ্রপাতে মুত্যুর প্রতিবেদনে দেখা যায় অনিরাপদ স্থানে থাকার কারণেই অকালে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। এ ক্ষত্রে বাঁচতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো নিরাপদ জায়গায় থাকতে হবে। বজ্রপাতকে গুরুত্বহীন মনে করার কারণ নেই। বিশেষ করে যারা ঘরের বাইরে ক্ষেতখামারে কাজ করেন তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। উঁচু স্থান অর্থাৎ উঁচু গাছ, ইলেকট্রিক পোল, মোবাইল টাওয়ার ইত্যাদি এরূপ বস্তুর সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। কেননা যে স্থান বা বস্তু যত উঁচু সে স্থান মেঘের তত সন্নিকটে থাকায় বজ্রপাতের আশঙ্কা তত বেশি। বাড়ির ছাঁদ কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান করলে দ্রুত সেখান থেকে নেমে নিরাপদ স্থানে যেতে হবে। মৌসুমে ঘনকালো (ঝড়মেঘ) মেঘ দেখলেই সাবধান হতে হবে এবং বৃষ্টি শুরুর আগে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। পাকা বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া বেশি নিরাপদ। তবে পাকাবাড়ি সুউচ্চ হলে সেক্ষেত্রে বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় জানালার কাছে না থাকাই ভালো। রাবারের স্যান্ডেল পরে থাকা এবং পানি ও যে কোনো ধাতববস্তু যেমন সিঁড়ি বা বারান্দার রেলিং, পানির কল ইত্যাদির স্পর্শ থেকে বিরত থাককেত হবে।
মোট কথা বিদ্যুৎ পরিবাহী যে কোনো বস্তুর স্পর্শ থেকে দূরে থাকতে হবে। পুকুর বা জলাশয়ে থাকা নিরাপদ নয়। বজ্রপাতে বাড়ির ইলেকট্রনিক্স জিনিসপত্র যেগুলোতে ইলেকট্রিক সংযোগ বা ডিসের সংযোগ থাকে সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা ভালো। নতুবা পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া এগুলো বন্ধ থাকলেও স্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে। মাঠের মধ্যে ফাঁকা জায়গায় থাকলে যদি বজ্রপাত হওয়ার অবস্থা তৈরি হয় তাহলে কানে আঙুল দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিচু হয়ে বসে থাকতে হবে। তবে মাটিতে শোয়া যাবে না, কেননা মটিতে শুয়ে পড়লে বিদ্যুৎ পৃষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। গাড়িতে থাকা অবস্থায় বজ্রপাতের পরিস্থিতি তৈরি হলে গাড়ির মধ্যে থাকা নিরাপদ। তবে মনে রাখতে হবে গাড়ির ধাতব কোনো অংশের সংস্পর্শ থেকে বিরত থাকতে হবে।
যত দিন যাচ্ছে প্রকৃতি বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রচার-প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। পাঠ্যবইয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়। বজ্রপাত কোথায় এবং কীভাবে ঘটছে, কী করলে ঝুঁকি কমবে জানলে ও মানলে বজ্রপাতে মৃত্যু লোপ পাবে।
সরকার বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করলেও এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ কম। বাংলাদেশে বজ্রপাতের পূর্বাভাস ও এলাকা শনাক্তকরণ যন্ত্র স্থাপন করা এখন সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সরকার বেশ কয়েকটি স্থানে বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্র বসালেও এর ফোরকাস্টিংয়ের ব্যবস্থা এখনো করতে পারেনি। আবার বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রাথমিক পর্যায়ে সারা দেশে ৫০ লাখ তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিলেও এটিও খুব একটি কার্যকর নয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আধুনিকায়নের ফলে ঝড়-বৃষ্টিতে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমেছে। জীবনযাত্রায় স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। অনেকেই ভ্রমণে যেতে চাইলে আবহাওয়ার বার্তা নিয়ে বের হচ্ছেন। যেহেতু বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়ছে সেহেতু এর ঝুঁকি প্রশমনে দৃশ্যমান উদ্যোগ গ্রহণ খুবই প্রয়োজন। তাহলে সাধারণ মানুষ সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করে ঘর থেকে বের হতে পারবে। বজ্রপাত পূর্বাভাস যন্ত্রের আধুনিকায়ন ও নতুন প্রযুক্তির ব্যবস্থাতেই এই ঝুঁকি কমানো সম্ভব। লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট