রবিবর, ১০ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:৪২ pm
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ভাইকে নিয়ে এ মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে লেখা সত্যিই কষ্টকর। কারণ, তার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন মনটা স্তব্ধ হয়ে গেছে। পরিবারের একজন শুধু নয়, আপন বড় ভাই মারা গেলে মনটা যেমন হয় তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়।
কারণ গত পরশু দিনও তিনি হাসপাতালের বেড থেকে ফোন করলেন। ফোনে তার গলাটা শুনে খুব ভালো লাগলো। একেবারে সুস্থ মানুষের গলা। তাই বিকেলে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ভাই ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ভাইকে ফোন করে বললাম, গাফ্ফার ভাইর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হলো। নিজের থেকে বেশি কথা বললেন তিনি দেশ নিয়ে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সমাজে যে আধুনিকতা কমে গেছে। ধর্মীয় অন্ধত্ব গেড়ে বসেছে। এ নিয়েই তিনি চিন্তিত।
আমরা বিদেশী অনেকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করি। এমনকি স্বাধীনতার পক্ষে যে সব দেশ ছিলো না তাদের রাষ্ট্র নায়কের মৃত্যুতেও। আশা করবো মহাকবির মতো এই সাংবাদিক গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্র একদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করবে।
আরও বললেন, মৃত্যুর আগে একটি আধুনিক বাংলাদেশ, বিশেষ করে যে জন্য দেশটি স্বাধীন হয়েছিল সে দেশটি দেখে যেতে পারলাম না। এমনি অনেক কথা। পরে ওনার ডাক্তার এসে গেলো। তিনি বললেন, স্বদেশ রাখি। পরে আবার কথা বলবো। কিন্তু সেই ‘পরে’ আর কোনোদিন পৃথিবীতে ফিরে আসবে না।
গাফ্ফার ভাইকে হাসপাতালের বেডে দেখে এসেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন আহমদ মানিক ভাই। তিনি গাফ্ফার ভাইয়ের গলার স্বর অনেক ভালো শুনে খুশি হলেন। কিন্তু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন শুধু একজন বড় লেখক নন, তিনি অনেক বেশি বাস্তববাদী। আমাদেরও জীবন সম্পর্কে তিনি অনেক পরামর্শ দেন, যা সত্যিই ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো। যে কারণে তার অনেক বন্ধু তাকে মামুন ফকির বলেন। তাই তাকে যখন বললাম, মামুন ভাই গাফ্ফার ভাইয়ের গলাটা খুব ভালো লাগলো। তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, স্বদেশ প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো একবার জ¦লে ওঠে।
অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের কথাই সত্য হলো। বাস্তবে আমাদের যে প্রদীপগুলোর আলোতে আমরা তারুণ্যে ও যৌবনে সামনে চলেছি তার শেষ প্রদীপ এ মুহূর্তে রেহমান সোবহান স্যার ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আনিসুজ্জামান স্যার চলে যাওয়ার পরে সব সময়ই গাফ্ফার ভাইকে নিয়ে ভয়ে ছিলাম। কারণ, তার শরীরটা অনেকদিন থেকে ভালো নয়। বিশেষ করে কিডনি দুটো অচল হয়ে আসছিল।
গাফ্ফার চৌধুরীকে আজকের প্রজম্ম শুধু সাংবাদিক হিসেবে আর একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে জানে। বাস্তবে দেশ ও জাতিকে দেওয়ার জন্যে, একটি দেশকে গড়ার জন্যে, সামরিক শাসন তাড়ানোর জন্যে, মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে সর্বোপরি দুর্নীতিমুক্ত একটি আধুনিক দেশ গড়ার জন্যে গাফ্ফার চৌধুরী সব থেকে বড় ত্যাগ করেছেন তার গল্প ও উপন্যাস লেখা।
গাফ্ফার চৌধুরীর গল্প ও উপন্যাসগুলো যদি এ প্রজম্ম পড়ে তারা দেখতে পাবে কী শক্তিশালী লেখক তিনি। গাফ্ফার চৌধুরী দেশের স্বার্থে, বিশেষ করে গণতন্ত্র, সেক্যুলারইজম ও আধুনিক দেশের জন্যে সাংবাদিকতায় সবটুকু সময় না দিতেন, যদি তিনি উপন্যাস ও গল্প লিখতেন তাহলে তার প্রজম্মের বাংলা সাহিত্যের নেতৃত্ব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নন তিনিই দিতেন। এবং তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে অনেক বেশি ইতিহাসনির্ভর ও জীবননির্ভর লেখা লিখতে পারতেন। কিন্তু শুধু দেশের স্বার্থে, প্রতিদিনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলমকে সচল রাখার জন্যে তিনি অমর থাকার মতো সাহিত্যকর্ম করা ত্যাগ করেছিলেন।
তাকে বার বার বলেছি, গাফ্ফার ভাই আপনি আবার উপন্যাস লিখুন। হেসে বলতেন শুরু করবো। আর শুরু করতে পারলেন না। যেমন তিনি শেষ করে যেতে পারেননি তার আত্মজীবনী, তেমনি তার কাছে কয়েক ট্রাঙ্ক বঙ্গবন্ধুর ডিকটেশান দেওয়া ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত নানান তথ্য ছিল, যা দিয়ে তিনি লিখতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর একটি জীবনী। সেটাও তিনি করে যেতে পারলেন না। আসলে ওই তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবি উপন্যাসের নায়কের কথাই বলতে হয়, ‘জীবন এত ছোট ক্যানে।’
তারপরও এই স্বল্প পরিসরের মানব জীবনে একটা দেশ ও জাতির জন্যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী যা দিয়ে গেছেন তা একজন মানুষের জীবনে দেওয়া সম্ভব নয়। সেই অসাধ্য কাজ তিনি করেছেন। আমরা তাকে দুটো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার দিয়েছি মাত্র। কিন্তু সত্যি অর্থে এই কালজয়ী নয়, এক মহাকবির শক্তিধারী কলমের সাংবাদিকের জন্যে যা করার উচিত ছিল তা জাঁতি হিসেবেও আমরা করিনি। রাষ্ট্রও সে কাজ করেনি।
আমরা বিদেশী অনেকের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয় শোক পালন করি। এমনকি স্বাধীনতার পক্ষে যে সব দেশ ছিল না তাদের রাষ্ট্র নায়কের মৃত্যুতেও। আশা করবো মহাকবির মতো এই সাংবাদিক গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে রাষ্ট্র একদিন রাষ্ট্রীয় শোক পালন করবে। লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক কলামিস্ট।