শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:২৭ am
বাংলাদেশের অর্থনীতি, অগ্রগতি, সম্ভাবনা সবকিছু দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজি ‘R’ আদ্যক্ষরের তিনটি শব্দের ওপর—Rice, Remittance, RMG. সোজা বাংলায় কৃষকের উৎপাদিত ধান, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স আর তৈরি পোশাক রপ্তানি—এই তিন হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ।
এই তিনটিই শ্রমঘন কাজ। সরলভাবে বললে, বাংলাদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে মেধা, প্রতিভা, দক্ষতার অবদান সামান্যই। বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে আসলে শ্রমিকের ঘামে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমে। আসলে বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজলভ্য হলো মানুষ, তাই সবচেয়ে সস্তা হলো শ্রম। কিন্তু যে শ্রমিকেরা আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে সেই শ্রমিকেরাই বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত।
কৃষকের কথাই ধরুন, সারাবছর অবর্ণনীয় পরিশ্রমে তারা ফসল ফলায়, আমাদের আহার জোগায়। কিন্তু তাদের কোনো ভয়েস নেই, কোনো সংগঠন নেই, গণমাধ্যমে তারা উপেক্ষিত, রাজনীতিবিদদের কাছে তারা অবহেলিত। সেচের পানি না পেয়ে কৃষকদের আত্মহত্যা করতে হয়।
মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদে ঠাঁই পেতে তাদের মরতে হয়, নয় তাদের বাঁধ ভাঙতে হয়, নয় বন্যায় ভেসে যেতে হয়, নয় নদী ভাঙতে হয়। তারা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না। সরকারের নানা সাহায্য তাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছায় না। একেবারে ভেসে যাওয়ার আগে আমরা তাদের নিয়ে একটু আহা-উহু করি বটে, কিন্তু তাতে তাদের কোনো লাভ হয় না।
প্রত্যেকবার ভরা মৌসুমে ধান, পাট, আলু, পেঁয়াজ, সবজির দাম এতটা কমে যায়; কৃষকের খরচের টাকায় ওঠে না, শ্রমের দাম তো অনেক পরে। আমি প্রতিবার ভয় পাই, এইবার কৃষক যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো, আগামীবার হয়তো এই কৃষক আর ফসলই ফলাতে পারবে না। কিন্তু আমাদের অদম্য কৃষকদের কখনো ধ্বংস করা যায় না।
মূলধারার গণমাধ্যমের সংবাদে কৃষকদের ঠাঁই পেতে তাদের মরতে হয়, নয় তাদের বাঁধ ভাঙতে হয়, নয় বন্যায় ভেসে যেতে হয়, নয় নদী ভাঙতে হয়। তারা পণ্যের ন্যায্যমূল্য পান না।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস-বন্যায় সবকিছু ভেসে গেলেও তারা মাটি কামড়ে পড়ে থাকেন। সরকারি সাহায্যের আশায় থাকেন না তারা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকার এক অনন্য শক্তি আছে তাদের। সেই শক্তির বলেই তারা ধ্বংস হতে হতে আবার উঠে দাঁড়ান। আবার ফসল ফলান এই ব-দ্বীপের উর্বর মাটিতে।
কৃষকেরা যদি সংগঠিত হতেন, তাহলে পদ্মা সেতুতে রেল চালু না করে, হাওর এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হতো। হাওরে টেকসই বাঁধের যে রিটার্ন পদ্মা সেতুর রেল দিয়ে তা আসবে না। কৃষকের লাভক্ষতি তারা বলতে পারে না, তাদের কান্না আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে না। তবুও কৃষক কারো দিকে না তাকিয়ে কাজ করে যায়।
কৃষকের কথা তবু আমরা কিছুটা জানি, শুনি, বলি; কিষানিদের কথা কোথাও লেখা থাকে না। কৃষকের পাশাপাশি তাদের ঘরের নারীরাও সমান তালে হাত লাগান। গ্রামের নারীদের এই অবদানের কথা জিডিপিতে থাকে না, উন্নয়নে থাকে না, গড় আয়ে থাকে না।
বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেক নিঃস্বার্থ যোদ্ধা প্রবাসী শ্রমিকেরা। বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ দেশের বাইরে থাকেন। তাদের সবাই রেমিট্যান্স যোদ্ধা নন। আমাদের মতো শিক্ষিত যারা নানা কারণে, নানা কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হন; তারা রেমিট্যান্স তো পাঠানই না; উল্টো দেশে থাকা সব সম্পত্তি বিক্রি করা টাকা পাচার করে নিয়ে যান নিজের ‘স্বপ্নের দেশে’। সেখানেই বাড়ি কেনেন, গাড়ি কেনেন, ভবিষ্যতের জীবন গড়েন। কালেভদ্রে তারা দেশে আসেন বেড়াতে। কিন্তু দেশের সাথে তাদের যোগাযোগ ঐটুকুই। কিন্তু দেশে এলে তাদের ঠাটবাটই আলাদা।
বিমানবন্দরে তাদের আলাদা সম্মান। এলাকায় সংবর্ধনা, ঢাকায় পার্টি- বেড়ানোর দিনগুলো উড়ে যায়। তারা টাকা পাঠান না, দেশ থেকে টানা নেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে তো বটেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের রেমিট্যান্স যোদ্ধারা অকল্পনীয় কষ্টে অর্থ উপার্জন করেন। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে থেকে উপার্জনের প্রায় পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন।
দেশে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তানের জন্য তাদের প্রাণ কাঁদে। কিন্তু খরচের ভয়ে দেশে ফিরতে পারেন না। অনেকে একেবারে দেশে ফেরেন। অনেকে ২/৩ বছর পর ফেরেন অনেক আশা নিয়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে। বিমানবন্দরে তাদের সাথে যে আচরণ করা হয়, আমি যতবার দেখেছি, লজ্জায় আমার মাথা নিচু হয়ে যায়।
যারা দেশ থেকে টাকা পাচার করে বিমানবন্দরে ভিআইপি মর্যাদা পায়। আর যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশে টাকা পাঠায় তাদের সাথে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করা হয়। গ্রামে ফিরে দেখেন, তার পাঠানো টাকায় ভাইয়ের বাড়িতে দালান উঠেছে, অনেকে ফিরে দেখেন স্ত্রী অন্যের হাত ধরে পালিয়েছে। তারা দেশের জন্য এতকিছু করেন, কিন্তু সামান্য মর্যাদাও পান না।
বাংলাদেশে এক প্রজন্মে বড়লোক হওয়া শ্রেণি হলো গার্মেন্টস মালিকেরা। নিজেরা বছর বছর গাড়ির মডেল বদলান। সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নেন, কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভাগ্য বদলায় না।
কৃষকের শ্রমটা আবহমানকালের। ওটা তাই আমাদের চোখে সয়ে গেছে। মনে হয়, কৃষকের কাজই তো ফসল ফলানো। স্বাধীনতার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের শ্রমিকদের ছড়িয়ে পড়া গ্রামীণ অর্থনীতিতে দারুণ চাঞ্চল্য এনেছে। একজনের বিদেশে যাওয়া একটি পরিবারের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বদলে দিয়েছে। তবে প্রবাসী শ্রমিকদের কাজটা আমরা চোখে দেখি না। তবে আমাদের চোখের সামনে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বদলে দিয়েছে গার্মেন্টস মানে তৈরি পোশাক খাত।
নারীর ক্ষমতায়নেও গার্মেন্টস খাতের ভূমিকা বিশাল। বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের মূল কারণ সস্তা শ্রম। এই ব্যাপারে বাংলাদেশের কোনো প্রতিযোগী নেই। কিন্তু সেই সস্তা শ্রমও আমাদের গার্মেন্টস ঠিকমতো দিতে চান না।
বাংলাদেশে এক প্রজন্মে বড়লোক হওয়া শ্রেণি হলো গার্মেন্টস মালিকেরা। নিজেরা বছর বছর গাড়ির মডেল বদলান। সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা নেন, কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের ভাগ্য বদলায় না। বাংলাদেশে মানুষ যেমন বেশি, শ্রম যেমন সস্তা, মানুষের জীবনও সস্তা।
একসময় বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতে দুর্ঘটনা লেগেই ছিল। ২০১৩ সালে রানা প্লাজায় ধসের ঘটনা বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য শাপেবর হয়েছে। ১ হাজার ১৭৫ জন মানুষের জীবনের বিনিময়ে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত হয়েছে গার্মেন্টস শিল্প। ঝুঁকি কমলেও আয় বাড়েনি খুব একটা। প্রতিবছর ঈদের আগে বেতন-বোনাসের দাবিতে গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনের খবর পাই। মালিকেরা সময়মতো বেতন-বোনাস-ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করেন না।
মানুষের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে যে দেশের অর্থনীতি, সেই দেশে শ্রমিকেরাই ভিআইপি মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে পদে পদে শ্রমিকেরা অবহেলা আর উপেক্ষার শিকার। এই বাস্তবতায় বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মে দিবস পালিত হয়। ১৮৮৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের সামনে দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন এবং আত্মাহুতির ঘটনা মানুষ স্মরণ করে বিশ্বজুড়ে। মে দিবস পালিত হয় বাংলাদেশেও। কিন্তু একদিনের সরকারি ছুটি ছাড়া বাংলাদেশের শ্রমিকেরা আর কিছু পায় না। বরং একদিন ছুটি থাকলে দিনমজুরদের আয় একদিন কম হয়।
ঈদ খুব নিকটে। ঈদ আনন্দ বয়ে আনে ঘরে ঘরে। কিন্তু আনন্দের জন্য কিছু বাড়তি অর্থও চাই। বাংলাদেশের সব শ্রমিক কি ঈদের আগে বেতন-বোনাস পেয়েছেন? ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়ায় এবার নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা কি তাদের কর্মচারীদের বেতন-বোনাস ঠিকমতো পরিশোধ করেছেন? এই সংঘর্ষে প্রাণ হারানো নাহিদ-মুরসালিনের পরিবারে তো এবার ঈদের আনন্দ উঁকি দিতে পারবে না। বাঁধ ভাঙার ভয়ে রাতজাগা হাওরের মানুষের ঘরে আনন্দ আসছে তো? এতসব শঙ্কার মধ্যেও ঈদ আসবে।
ঈদ এমন এক উৎসব, যা ধনী-গরিব সব মানুষকে আনন্দের এক কাতারে সামিল করে। আমরা যেন আমাদের পাশের জনকেও আনন্দে সামিল করে নেই। চাষাদের, মুটেদের, মজুরের/গরিবের নিঃস্বের ফকিরের/আমার এ দেশ সব মানুষের, সব মানুষের। আনন্দটাও যেন সব মানুষেরই হয়।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ, [email protected]