শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৭:৩২ am
বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী দেশ পাকিস্তানের ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হেরে যাওয়া প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নাম লেখালেন ইমরান খান। ১৯৪৭ সালের পর যতবার যত সরকার ক্ষমতায় এসেছে পাকিস্তানে, ততবারই ৫ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অব্যহত থাকলো এই হেরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। সেই সাথে যোগ হয়েছে একটি কথা, আর তা হলো- দেশটির ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হেরে কোনো প্রধানমন্ত্রী পদ হারাননি। খবর জিও নিউজের।
বিরোধীদের অনাস্থা প্রস্তাবে ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়েছে ১৭৪টি। প্রস্তাব পাসের জন্য দরকার ছিল ১৭২ ভোট। পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইমরান খান। তার পতনের মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। এরই মধ্যে ইমরান খান ইসলামাবাদ ছেড়েছেন বলে খবর প্রকাশ পেয়েছে। অথচ এই ইমরান খান ছিলেন নীতিতে অটল, ছিলেন দেশের জন্য নিবেদিত বীর। সেই ইমরান খানকে হারাতেই অনাস্থা ভোটের আগে ইমরান খানের সমর্থক ও বিরোধীদের মধ্যে সংসদের ভেতর তুমল হট্টগোলে জাতীয় পরিষদের স্পিকার সাময়িকভাবে অধিবেশন মুলতবি করেন। এর দুই ঘণ্টা পর আবার অধিবেশন শুরু হয়। পরে দেওয়া হয় যোহরের নামাজের বিরতি। এরপর পুনরায় শুরু হলে আবারও হট্টগোলে বিরতিতে যান স্পিকার। পরে দুদফায় দেওয়া হয় ইফতার ও এশার নামাজের বিরতি। রাত সাড়ে ৯টায় তা আবার শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিলম্বিত হয়। শেষমেষ পাকিস্তান সময় শনিবার রাত ১২টা বাজার ১০ মিনিট আগে অনাস্থা ভোট শুরু হয়। রাতভর নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে (পার্লামেন্ট) অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। এখন অবশ্য বলা হচ্ছে- জাতীয় সরকারের মতো নতুন ফেডারেল সরকার গঠন করা হবে। এতে আনুপাতিক হারে শরিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
নতুন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে এর মেয়াদ ছয় মাস অথবা এক বছর রাখার বিষয়টি বর্তমানে বিবেচনায় রয়েছে। এই মেয়াদের মধ্যে নির্বাচনি সংস্কার ও জবাবদিহি–সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো পাস হতে পারে। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে সংসদীয় আসনের সীমানা পুননির্ধারণে নির্বাচন কমিশনকে যৌক্তিক সময় দেওয়া হবে। এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, আর তা হলো- মূলত ইমরানকে হটাতে পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলো এক হয়েছিল। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে একটি শক্তিশালী জোটও গঠন করেছিল তারা। ২০১৯ সালে ইমরান খান সরকারের পতন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে দেশজুড়ে লংমার্চ করেছিলেন পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (জেইউআই-এফ) প্রধান মাওলানা ফজলুর রহমান। সেসময় মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ প্রায় সব বিরোধী দলই মাওলানার আহ্বানে আজাদি মার্চে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। মূলত তখন থেকেই রাজপথে প্রকাশ্যে ইমরান খান বিরোধী তৎপরতা নজরে আসে।
এছাড়া পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এন-র (পিএমএল-এন) বর্তমান প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ, মাওলানা ফজলুর রহমান ও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির যৌথ প্রচেষ্টাতেই ইমরান সরকারের পতন হয়েছে।
যদি পাকিস্তানের রাজনীতিতে শাহবাজ শরীফের রাজনৈতিক কূটকৌশলের কথা বলি, তাহলে দেখা যাবে- শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা। এর বাইরে তার আরেকটি পরিচয় আছে। তিনি তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের আপন ছোট ভাই। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার পর নওয়াজ শরীফ লন্ডনে নির্বাসিত জীবন-যাপন করছেন। শাহবাজ শরীফ পাকিস্তানের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার আগে পাঞ্জাব প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি পাঞ্জাবের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। শাহবাজ শরীফ সবমিলিয়ে তিনবার পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৭ সালে প্রথমবার মূখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশারফ ক্ষমতা দখল করলে শাহবাজ শরীফ সৌদি আরবে পালিয়ে যান। আট বছর সৌদিতে নির্বাসিত থাকার পর ২০০৭ সালে তিনি পাকিস্তানে ফেরেন। ২০০৮ সালে তার দল জয় পেলে ফের তিনি পাঞ্জাবের মূখ্যমন্ত্রী হন। ২০১৩ সালে তৃতীয়বার তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ২০১৮ নির্বাচনে মুসলিম লিগ-এন হেরে যায়। এরপরই শাহবাজ শরীফকে প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা বানানো হয়। ৭০ বছর বয়সী শাহবাজ দেশের বাইরে শাহবাজ ততটা পরিচিত নন। লন্ডন ও দুবাইয়ে বিলাসবহুল বাড়ি থাকার কারণে খবরের শিরোনাম হলেও দেশের ভেতরে প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য শাহবাজের সুনাম রয়েছে।
ধর্মকে পূঁজি করে রাজনীতি যারা করছে পাকিস্তানে, তাদের মধ্যে মাওলানা ফজলুর রহমান অন্যতম প্রধান। তাঁর রাজনীতি কেবল অন্ধকারের পথ ধরেই এগিয়ে যায় নি, নিয়ে এসেছে ছলাকলার অন্ধকার। মাওলানা ফজলুর রহমান পাকিস্তানের জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের (জেইউআই-এফ) বর্তমান সভাপতি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ। ১৯৮৮ সাল থেকে বর্তমান পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য তিনি। ১৯৮১ সালে তিনি যখন জেনারেল জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কারাবন্দি হন তখন তাকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব নির্বাচন করা হয়। মাওলানা ফজলুর রহমান রাজনৈতিক মামলায় মোট ১০ বার কারাবরণ করেছেন। ১৯৯৩ সনে বেনজীর ভূট্টো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে মাওলানা ফজলুর রহমান জাতীয় সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালে ইমরান খানের পদত্যাগ এবং পুনরায় নির্বাচন দাবিতে মাওলানা ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তান জুড়ে আজাদি মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় কয়েক লাখ কর্মী-সমর্থক নিয়ে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে কয়েক দিন অবস্থান করেন তিনি। ইমরান খানের হেরে যাওয়ার পেছনেই শুধু নয়; আসিফ আলি জারদারি রয়েছে সকল স্তরে ষড়যন্ত্রসহ। এই ব্যক্তিটি দেশের কল্যাণে তেমন কোন কাজ না করলেও হট্টগোল-গন্ডগোলে তিনি নিরন্তর রাজপথে থেকেছেন। আসিফ আলি জারদারি পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) কো-চেয়ারম্যান। পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর স্বামী জারদারি ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পিপিপি দেশটির বর্তমান পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল।
মায়ের মত ত্যাগী না হলেও বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি চেষ্টা করছেন ক্ষমতায় আসতে। তার প্রমাণ আমরা পাবো তাঁর কর্মকান্ডগুলো দেখলেই। পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বেনজির ভুট্টো ও আসিফ আলি জারদারির ছেলে। সন্ত্রাসী হামলায় তার মা বেনজির ভুট্টো নিহত হওয়ার পর মাত্র ১৯ বছর বয়সে পিপিপির চেয়ারম্যান হন তিনি। অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করা ৩৩ বছর বয়সী বিলাওয়াল ভুট্টো একজন প্রগতিশীল নেতা হিসেবে পরিচিত। বিলাওয়াল ভুট্টো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুবই জনপ্রিয়। যদিও উর্দু ভাষায় দুর্বল হওয়ায় তাঁকে প্রায়ই উপহাসের পাত্র হতে হয়। এই উপহাসের পাত্ররাই চেষ্টা করে যাচ্ছে ছাত্র-যুব-জনতার অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে খাদের কিণারে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা। সেই চেষ্টার পথ ধরেই ইমরান খানের ‘ভাগ্যনির্ধারণী’ অধিবেশন নিয়ে নাটকীয়তা তৈরি করা হয়েছিলো। রাতভর নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে (পার্লামেন্ট) অনাস্থা ভোটে হেরে ইমরান খান প্রধানমন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। স্পিকারের পদত্যাগের পর তার ভাগ্য নির্ধারণী ভোট অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) সদস্য আয়াজ সাদিকের পরিচালনায় অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে ৩৪২ জন আইনপ্রণেতার মধ্যে ১৭৪ জন ভোট দেন। যদিও বিরোধীদের ১৭২ জনের সমর্থন দরকার ছিল।
একটু গভীরে তাকালে দেখবো যে, পাকিস্তানের পার্লামেন্টে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার অধিবেশন নিয়ে নাটকীয়তার সৃষ্টি হয়েছিল। এই নাটকীয়তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে বাংলাদেশকে। মনে রাখতে হবে- ষড়যন্ত্র হতে পারে যে কোন সময়। এই ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করতে তারুণ্যের রাজনীতিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে স্বাধীনতার চেতনায় আলোকিত হয়ে। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন- তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) দাবি করেছে- সুপ্রিমকোর্ট সংবিধান লঙ্ঘন করে ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন। সুপ্রিমকোর্ট ৭ এপ্রিল নির্দেশ দেন-অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট করতে হবে। পিটিআইয়ের দাবি-প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের যে বেঞ্চ ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের নির্দেশ দিয়েছেন, সেটি তারা ভুলের ওপর দিয়েছেন।
ইমরানের দল আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এনেছে। তাদের দাবি, পাকিস্তানের সংবিধানে আছে-এমপি, এর অন্য কর্মকর্তা, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী কোনো আদালতের কাছে তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। তারা জানান, সংবিধানে আরও আছে-তাদের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে আদালতও প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। আপিলে ইমরান খানের দলের দাবি-ডেপুটি স্পিকার কাশেম সুরির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালত সংবিধানের ১৭৫ নম্বর ধারা লঙ্ঘন করেছেন। ৩ এপ্রিল ডেপুটি স্পিকার কাশেম সুরি জানিয়েছিলেন, ইমরানের বিরুদ্ধে বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ফলে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা সংবিধান পরিপন্থি। এরপর ইমরানের আহ্বানে দেশটির প্রেসিডেন্ট আইনসভা ভেঙে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী দলগুলো সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হয়। এভাবে সুপ্রীম কোর্টের দ্বারস্থ কি হতে হবে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোকেও? নাকি কোন কোন দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীরা মেতে উঠবেন ষড়যন্ত্রের জাল নিয়ে? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন তাকিয়ে থাকি পাকিস্তান, ভারত থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে… মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি।