শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৯:২৮ pm
নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলায় গত ২৩ মার্চ ধানের জমিতে পানি না পেয়ে দুই আদিবাসী কৃষক আত্মহত্যা ঘটনার সুষ্ঠ বিচার চেয়ে ও বিএমডিএর গভীর নলকূপ পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করে হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন আদিবাসীরা।
রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটির আয়োজনে প্রতিবাদের অংশ হিসেবে সোমবার (১১ এপ্রিল) রাজশাহী জেলা প্রশাসকের অফিসের সামনে মানববন্ধন ও প্রধানমন্ত্রী বরাবর রাজশাহীর জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে একটি ম্মারক লিপি প্রদান করেছেন।
স্মারকলিপিতে রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা, উপদেষ্ঠা প্রসেন এক্কা, সিসিবিভিওর প্রতিনিধি আরিফ, মৃত কৃষক অভিনাথ মার্ডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম, মৃত রবি মার্ডির বড় ভাই সুশীল মার্ডি ও রক্ষগোলা সমন্বয় কমিটির সদস্য রঞ্জিত সাওরীয়ার স্বাক্ষর রয়েছে।
পরে তারা আদিবাসীদের অংশ গ্রহণে বিশাল মিছিল নিয়ে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) প্রধান কার্যালয়ের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
সেখানে আদিবাসীরা পৌছে বিএমডিএর চেয়ারম্যান বেগম আকতার জাহানের সাথে দেখা করে বিভিন্ন দাবি দেওয়া ও পানি প্রদানের নানান অব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন অনিয়মের দাবি নিয়ে দেখা করতে যায়। তবে বিএমডিএর চেয়ারম্যান অফিসে না থাকায় বিএমডিএর সচিব ইকবাল হোসেনের সাথে দেখা করে প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে স্মারকলিপি ও দাবি তা আনুষ্ঠানিক ভাবে তুলে ধরেন।
আদিবাসীরা এই ঘটনায় সুষ্ঠ বিচার হস্তক্ষেপ কামনা করে স্মারক লিপিতে বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। সেগুলো হলো- গত ২৩ মার্চ বিকেলে পেদাগাড়ী উপজেলাধীন নিমঘুটু সপ্তাল পল্লীর অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি ধানের জমিতে সেচের পানি না পেয়ে এবং বি.এম.ডি.এ.-এর গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের অসদাচারনের ফলে বিষপানের করণে ঐ দিনই অভিনাথ মার্ডি মৃত্যু বরণ করেন। আর তার ভাই রবি মার্ডি ২৫ মার্চ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হৃসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে।
ঘটনার অব্যবহিত পরে আমরা সাখাওয়াত হোসেনের নামে গোদাগাড়ী থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের অসহযোগিতা ও অবহেলার দরুন ঘটনার ২ দিন পর ২৫ মার্চ আমরা মামলা দায়ের করতে সমর্থ হই ।
উল্লেখ্য যে গভীর নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াত হোসেনের নামে দীর্ঘদিন ধরেই সেচের পানি প্রদানের ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ থাকলেও তিনি সেগুলোর কোন তোয়াক্কায় করেন নি। উপরস্তু সেই গভীর নলকূপের আওতাধীন চাষযোগ্য জমির অর্ধেক কৃষক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি হওয়া সত্ত্বেও বরাবরই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কৃষকদের দেরীতে সেচের পানি প্রদান করা হতে।
আত্মহত্যার পূর্বে অভিনাথ ও রবি মার্ডি প্রায় ১২-১৫ দিন ধরে ধানের জমিতে পানি সেচের কথা নলকূপ অপারেটর সাখাওয়াতকে বলে আসছিলো কিন্তু তাদের জমিতে পানি প্রদান করা হয় নি।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কৃষকের আত্মহননের পেছনে সখাওয়াত হোসেনের মতো জাতিবিদ্বেষী দুর্নীতিবাজ ডীপ অপারেটর যেমন দায়ী ঠিক তেমনি এই বরেন্দ্র অঞ্চলের কার্যক্রম পরিচালনাকারী সংস্থা বিএমডিএ’র অব্যবস্থাপন ও অনিয়ম সমানরূপে দায়ী।
খোদ কৃষি মন্ত্রণালয়ের তদন্তে উঠে এসেছে সাখাওয়াত হোসেন বি.এম.ডি.এ. কর্তৃক নির্ধারিত পানির দাম ১২৫ টাকা ঘন্টার পানি ১৩৫ টাকায় কৃষকদের কাছে বিক্রি করতেন, এই অনিয়ম বহুদিনব্যাপী চলমান থাকলেও কর্তৃপক্ষের কোন তদারকি ছিলো না।
গোটা বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচের পানি গভীর নলকূপ অপারেটরদের কবজায়, যাদের হাতে জিম্মি হয়ে আছে প্রায় ৪ লাখ কৃষক। নলকূপ অপারেটর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও বি.এম.ডি.এ কর্তৃপক্ষ স্বার্থবাদী চক্র ও দলীয় সমর্থন বিবেচনায় রাখে যার ফলে নলকূপগুলোর পানি বন্টন নীতি দলীয় নেতা-কর্মীদের স্বেচ্ছাচারিতার অংশ হয়ে গেছে, এক্ষেত্রে এসকল অসৎ নলকূপ অপারেটররা যে ক্ষমতাসীন দলের নামের অপব্যবহার করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
এর আগে সাখাওয়াত হোসেনের বিরুদ্ধে ২০২০ এবং ২০২১ সালে স্থানীয় কৃষকরা বি.এম.ডি.এ. কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত অভিযোগ দাখিল করলে কর্তৃপক্ষ সেই অভিযোগ আমলে নেয় নি। ক্ষেত্র বিশেষে পানি সমস্যা নিরসনে অসৎ অপারেটরকে বরখাস্তের জন্য করা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির সুপারিশকেও নজরান্দাজ করা হয়েছে।।
তারা আরো অভিযোগ করেন, বি.এম.ডি.এ’র কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও অসৎ নলকূপ অপারেটররা মিলে বরেন্দ্র অঞ্চলে একটি পানি মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করেছে যার শিকার এই লক্ষ লক্ষ অসহায় কৃষক।
সাখাওয়াত হোসেন কর্তৃক নলকূপ ব্যবস্থাপনা ও সেচের ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি ও অনিয়ম করে গভীর নলকূপের ট্রান্সমিটার পাহারা দেবার জন্য প্রতি মৌসুমে কৃষকদের কাছে থেকে জনপ্রতি ২০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা উত্তোলন করা হত যা খরচের কোন হিসেব নেই। চেম্বার মেরামতের জন্য কৃষকপ্রতি ৫০ টাকা উত্তোলন করা হতো। সেচের পানি প্রদানের ক্ষেত্রে কোন সিরিয়াল অনুসরণ করা হতো না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ক্ষেত্রে সিরিয়াল থাকলেও ৮- ১০দিন ঘোরানো হতো। নলকূপ অপারেটর স্ক্রিমভুক্ত জমিতে নিজের পাওয়ার টিলার ছাড়া অন্য কোন পাওয়ার টিলার ব্যবহার করতে দিত না এবং বেশি চার্জ আদায় করতো।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ক্ষেত্রে পানি না দেবার ভয় দেখিয়ে বিনা পারিশ্রমিকে বাড়ির কাজ করিয়ে নিতো। সেচের পানির জন্য পীড়াপীড়ি করলে কৃষকদের বলতো, ‘তোদের পানি দেয়া হবে না, পারলে কেস কর গা’।
ডীপ টিউবয়েলের কোন কিছু নষ্ট হলে ৫০০ টাকার খরচের জন্য কৃষকদের কাছে থেকে ৫০০০ টাকা আদায় করতো। আমাদের পানি উত্তোলনের কার্ড থাকলেও অপারেটর তার নিজের কার্ড ব্যবহারে বাধ্য করতো। বেশি টাকা আয়ের জন্য নির্ধারিত স্কিমের চেয়ে দ্বিগুণ জমিতে সেচ দিত। ডীপ অপারেটর নীতিমালার বাইরে জমি প্রতি টাকা ও ধান উত্তোলন করতো। ডীপ অপারেটরের মতের সাথে সম্মতি না দিলে সেচের পানি দেয় না। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কৃষকদের ক্ষেত্রে গভীর রাত ছাড়া সেচের পানি প্রদান করে না। ডীপ অপারেটরের নিজস্ব আবাদী জমিতে জোরপূর্বক কম মজুরিতে কাজ করাতে বাধ্য করতো।
আদিবাসীদের বর্গা চাষের জন্য ১০ বিঘা জমি থাকলে পানি না দেওয়ার হুমকি দিয়ে ২ বিঘা জমি জোর পূর্বক বর্গা চাষের জন্য কেড়ে নিত। উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলো দীর্ঘদিন যাবত উক্ত ডীপের আওতায় থাকা কৃষকদের সাথে ঘটে এসেছে। বিএমডিএ কর্তৃপক্ষের কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে অবহেলা ডীপ কেন্দ্রিক অপারেটরদের এক ধরনের জমিদারী কায়েম করেছে যার কাছে কৃষকরা অসহায় প্রজা মাত্র।
আমরা মনে করি বিএমডিএ কর্তৃপক্ষ বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার নামে যে শোষণ যন্ত্র তৈরী করেছে তার দায় এড়াতে পারে না। এই অঞ্চলে ডীপ অপারেটরদের কাছে থেকে কৃষকদের জিম্মি দশা লাঘবে সুষ্ঠু তদারকি ও জবাবদিহিতার জায়গা তৈরী করা না গেলে ভবিষ্যতে আরো বহু অসহায় অভিনাথ বা রবি মার্ডি আত্মহননের পথ বেছে নেবে।
স্মারকলিপিতে তাদের দাবি গুলো হলো :
অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডির আত্মহত্যায় প্ররোচণা প্রদানকারী সাখাওয়াত হোসেনকে বিচারের মাধ্যমের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ কার্যক্রমের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের জন্য বিএমডিএ কর্তৃপক্ষকে তদন্তের আওতায় এনে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে ডীপ পরিচালনার ক্ষেত্রে কৃষকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং সুষ্ঠু তদারকির বিধান রাখতে হবে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে ডীপ অপারেটর হিসেবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ও প্রপ্তিক কৃষকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের ও প্রন্তিক কৃষকদের পর্যাপ্ত পরিমাণে সেচের পানির অভিগম্যতার সুযোগ নিশ্চিতকল্পে নীতিমালায় সুস্পষ্ট বিধান থাকতে হবে।