শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৫:০৯ pm
চলতি মাসের পহেলা মার্চ মারুফের এক বছর পূর্ণ হলো রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চাকরির। রাজশাহী সরকারী পলেটেকনিক থেকে ইলেকট্রোমেডিক্যালে ডিপ্লোমা পাশ করা তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারী সে। বাবা মা’র একমাত্র সন্তান হওয়ায় তাদের স্বপ্ন ছিলো বড়। তবে মারুফ বেড়ে ওঠার সাথে সাথে শারীরিক পরিবর্তন বুঝতে পারে মারুফ ও তাঁর পরিাবার। ফলে আর দশটা ছেলেমেয়ের মতো স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগটা হারিয়ে ফেলে মারুফ। তবে অদম্য মারুফ হাল না ছেড়ে শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের মহানুভবতায় (মাস্টার রোলে) চাকরির সুযোগ ও নিজ দক্ষতায় এক বছর পার করেছে চাকরিতে।
মারুফ জানান, ডিসি স্যার আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। তিনি আমার চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন ও নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছেন। আমিও এ সমাজের অংশ এটি একবছর আগেও ভাবতে পারিনি। সারাক্ষণ প্রতিবেশিদের অবজ্ঞা, সমাজের নিষ্ঠুর আচরণ আমার আত্নসম্মানবোধটাকেই হারিয়ে দিয়েছিলো। এখন আমি আমার জায়গা থেকে সমাজকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করছি। সে সুযোগ জেলা প্রশাসক স্যার করে দিয়েছেন আমাকে ও জনিকে। চাকরি পাবার পর থেকে আমাদের মতো তৃতীয় লিঙ্গের যারা রয়েছেন তাঁরাও নতুন আলো দেখছেন । নতুন করে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি না ভেবে অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে সবাই। স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। তবে তিনি আমাদের জনগোষ্ঠির জন্য রাজশাহীতে যে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন এই জনগোষ্ঠি আমৃত্যু তা স্মরণ রাখবে।
মারুফ আরোও জানান, পরিবার থেকে আমাকে টাকা নিতে হয়না। আমি এখন স্বাবলম্বী। পরিবার প্রতিবেশিরাও ইতিবাচক ভাবে দেখছে। সৎ ভাবে উপার্জন করে আত্নসম্মানবোধ তৈরি হয়েছে আমার। জেলা প্রশাসক স্যার যে নজির গড়ে দিয়েছেন তা অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক। এতে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সমাজের কাছে আরো আপন হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি।
তৃতীয় লিঙ্গের অন্য সদস্য জনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মারুফের সাথে কাজ করছেন। তিনি জানান,আগের চেয়ে অনেক ভালো আছেন। এখন আর টাকার জন্য কারো কাছে নিজের হাত পাততে হয়না। যা বেতন পান তা দিয়ে ভালো আছেন।
দিনের আলো হিজরা সংঘের সভাপতি মোহনা বলেন, প্রায় দুই বছর আগে যখন করোনার প্রভাব পড়তে শুরু করে তখন আমরা ডিসি স্যারের কাছে গিয়েছিলাম এক টন চাউলের জন্য। স্যার সেই সময় দুই টন চাউল দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনিই আমাদের খোঁজ নিতেন ফোন দিয়ে কোন সমস্যা আছে কিনা। স্যারের ফোন আসার পর আমি ও আমাদের সদস্যরা সাহস ফিরে পেয়েছি। স্যার যেভাবে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন আমাদেরকে এভাবে অনেকে পাশে রাখেনি। তিনি সুযোগ করে দেয়ায় প্রায় মিটিংয়ে অংশ নিয়ে আমি শিখেছি কতোটা পিছিয়ে ছিলাম আমরা। এখন জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটি ও এনজিও সমন্বয় মিটিংয়ের সদস্য আমি। অথচ ডিসি স্যার পাশে না দাড়ালে কোনদিনও এগুলো ভাবতেও পারতাম না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বীকৃতি দেয়ার পর কিছুটা কাজ হচ্ছিলো। তবে জেলা প্রশাসক স্যার যেভাবে আমাদের জনগোষ্ঠিকে সহায়তা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন তা কল্পনার বাইরে।জেলা প্রশাসক স্যারের কার্যালয়ে আমাদের জনগোষ্ঠির দুইজনকে চাকরি দেয়ায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে সারা বাংলাদেশে আমাদের কমিউনিটির মধ্যে। তাছাড়া অন্যান্য স্যার,ম্যাডামরা সহযোগিতা করছেন তাদেরকে। তৃতীয় লিঙ্গের অনেকে পড়ালেখা করতে ইচ্ছা পোষণ করছে নতুন করে।
মোহনা আরো জানান,আব্দুল জলিল স্যার আসার আগে এক সময়ে আমরা যেয়ে যেয়ে সহযোগিতা চাইতাম কিন্তু স্যার নিজে থেকেই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। পলি জয়িতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কাটাখালীতে হেনা নামের একজন ডিম বিক্রি করছে। রাজশাহী শিরইল বাসস্টান্ডের পাশে রোকন মুদি দোকানদারি করছে,সুমি বর্নালীর মোড়ে চায়ের দোকানে কাজ করছে, রতন ও প্রিয়া নদীর ধারে ফুল বিক্রি করছে। স্যারের দুইজনকে চাকরি দেয়া ও আমাদেরকে মূল ধারার সাথে সংযুক্ত করার কারনে এখন দৃষ্টিভঙ্গী বদলাচ্ছে সবার। আরো ২০ বছর আগে যদি এই কাজটি কোন সরকারি কিংবা বেসরকারি কর্মকর্তা শুরু করতো তবে তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা আরো অনেকে ভালো ভালো জায়গায় মত প্রকাশের সুযোগ ও স্বাবলম্বী হতো বলে আমি মনে করি।
তিনি আরো বলেন, চাকরি প্রাপ্তদের যতদিন পর্যন্ত সরকারিভাবে স্থায়ী নিয়োগ দিতে না পারবেন ততদিন পর্যন্ত জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে মাসিক একটি সম্মানী ভাতা দেওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
এছাড়া পুলিশ বিভাগ ও অন্যান্য প্রশাসনে তাদের চাকরি দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন জেলা প্রশাসক স্যার। বাংলাদেশে কেউ কিন্তু এরকম চিন্তা করেননি সরকারী দপ্তরে চাকরি দেয়ার। আমরা সৌভাগ্যবান এরকম স্যারকে পেয়ে। তিনি আরো ওপরে উঠবেন আমাদের দোয়া ও ভালবাসা থাকবে সবসময়।
তৃতীয় লিঙ্গের সুযোগ সুবিধা ও সমাজের মূল ধারায় আনার বিষয়ে রাজশাহী জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, আমি আমার জায়গা থেকে সকলের জন্য কিছু করার চেষ্টা করছি। রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গার তহসিল অফিসের পাশে একটি জায়গা দেখা হয়েছিলো তবে সেখানের একপাশে মাদ্রাসা ও অন্যপাশে হাইস্কুল থাকায় আপাতত সেই প্ল্যান থেকে সরে এসেছি। নতুন জায়গা খোঁজা হচ্ছে সেখানে এক সাথে ৫০ টি ঘর করার এক্সক্লুসিভ প্ল্যান রয়েছে। প্রতিটি ঘরে চারজন করে মোট ২০০ জন তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা থাকতে পারবে। আমরা এমন একটি জায়গা খুজছি সেখানে তাদের প্রতিবেশি যারা হবে যেনো বিব্রতবোধ না করে। এটা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় আমাদের জন্য। একটি প্রস্তাব ইতমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে তাদের পুর্নবাসন করে আশ্রয়নের ব্যারাক তৈরি করার জন্য। প্রস্তাবটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই মুজিব শতবর্ষে আশ্রয়ন প্রকল্পে ব্যক্তিগত যে ঘর দেয়া হচ্ছে সেরকমও করা যেতে পারে।
ডিসি আব্দুল জলিল আরো বলেন, এখানে যে মারুফ ও জনি নামে যে দুইজন কাজ করছে তারা খুবই বিনয়ী আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। অনেক ভালো করছে। আমার অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা তাদের সহযোগিতা করছে সবসময়। সবাই যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন তবে এই কমিউনিটি খুব তাড়াতাড়ি শেকল ভেঙ্গে আলোর পথে আসবে বলে আমার বিশ্বাস। রির্পোট, শাহ্জাদা মিলন, উত্তরা প্রতিদিনি