রবিবর, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৪:০৯ am
ডেস্ক রির্পোট : সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপে আজ সংলাপে বসেন নির্বাচন কমিশনাররা। সেখানে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন বিশিষ্টজনরা। সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার বিষয়। শুধু বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে নয়, কাজ দিয়ে নিজেদের নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে কমিশনারদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। যদি কমিশন নিরপেক্ষভাবে কাজ করার সুযোগ না পায়, সেক্ষেত্রে তাদের পদত্যাগ করার আহ্বানও জানান সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
এছাড়া ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করা, ইভিএম নিয়ে বিতর্কের অবসান, ডিজিটাল কারচুপি রোধ, দলীয় সরকারের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করা, নির্বাচনকালীন মাঠে সব প্রার্থী ও তার সমর্থকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে মতামত দেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার তাগিদ দেন তারা।
সংলাপে বিশিষ্টজনদের মতামত পর্যালোচনা করে অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
মঙ্গলবার (২২ মার্চ) সকালে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সংলাপের আয়োজন করা হয়। এতে ৪০ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে সংলাপে অংশ নেন বিভিন্ন পেশার ১৯ বিশিষ্টজন।
তারা হলেন- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, মোস্তাফিজুর রহমান ও সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক শামীম রেজা, আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন, লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বেগম শাহীন আনাম, নিজেরা করি’র কো-অর্ডিনেটর খুশী কবির, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ইনডিজিনিয়াস পিপলস ফোরাম সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড রাইটস সেন্টারের প্রেসিডেন্ট জহুরুল আলম ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দীন আহমেদ।
ইসিকে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে হবে
সংলাপে সবচেয়ে গুরুত্ব পায় নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার বিষয়টি। এতে অংশ নেওয়া ১৯ বিশিষ্টজনই ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা আগামী নির্বাচনে কাজের মাধ্যমে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে কমিশনারদের প্রতি আহ্বান জানান।
সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনা ইসির চ্যালেঞ্জ হবে। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কি না, তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।’
লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, ‘ইসির এত সংলাপ করার অর্থ হচ্ছে, এখানে সংকট রয়েছে। আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারেন তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে আমি আশাবাদী মানুষ।’
নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরন কেমন নির্বাচন হবে, এ নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায়, সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করার ওপর জোর দেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, ‘সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোনো পরিবর্তন করা যায় কি না, তা চিহ্নিত করেন আপনারা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।’
সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ক্ষমতায় থেকে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গত দুটি নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়টি সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছেন। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ভোটের আগে ও পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এজন্য ভোটের আগে চার মাস এবং ভোটের পরে দুই মাস- এই ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সংকটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।’
সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ ও সত্য বলার পরামর্শ দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘দেশের বিরাট একটি রাজনৈতিক দল বয়কট করে বেড়াচ্ছে, এটা তো বিরাট সমস্যা। অনেকে বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়।’
ইভিএম ব্যবহার না করতে জোর দাবি
সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইভিএমের ব্যবহার চরমভাবে বিতর্কিত হচ্ছে। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম নিয়ে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। ইভিএম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা উচিত নয়।’
সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। এটাকে (ইভিএম) এড়িয়ে একটি ভালো ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন দেবেন।’
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না, তা নিশ্চিত না করে আর ব্যবহার করা যাবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলবো- ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য।’
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীও ইভিএমের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারেন। তবে এটা না হওয়াই ভালো।’
ইভিএম নিয়ে যা বললেন সিইসি
ইভিএম নিয়ে বিতর্ক এবং তা আগামী নির্বাচনে ব্যবহার না করার বিষয়ে বিশিষ্টজনদের মতামতের পর তা বিবেচনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল।
বিশিষ্টজনদের পরামর্শের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি বলেন, ‘ইভিএমে অনেকে অভ্যস্ত নয়। ইভিএমের প্রতি আস্থা নিয়েও কথা উঠেছে। ইভিএমে কোনো অসুবিধা আছে কি না, মেশিনের মাধ্যমে ভোটে কোনো ডিজিটাল কারচুপি হয় কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে।’
তবে ইভিএমের নেতিবাচকের চেয়ে ইতিবাচক দিকই বেশি বলে উল্লেখ করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘ইভিএমের ভালো দিকও রয়েছে, দ্রুত ভোট গণনা করা যায়। তবে পুনর্গণনা নিয়ে সমস্যা রয়েছে। কারিগরি কমিটির সঙ্গে বৈঠক করে ইভিএম সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, সঠিক হলে তা চালিয়ে যেতে হবে। কাজে না লাগলে বর্জন করাই ভালো। এসব মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সিইসির মতে, যে দল সরকারে থাকে, তাদের কিছুটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ থাকে। কারণ প্রশাসন, পুলিশ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসি তাদের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, তা আলোচনার বিষয়।
তিনি বলেন, ‘আমরা এনফোর্সমেন্টটা যেন ভালোভাবে করতে পারি, সেই চেষ্টা করবো। এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে পারলে তৃণমূলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হয়। তাহলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গণ্ডগোল হবে না। অনুকূল পরিবেশ পাবো।’
তবে রাজনৈতিক সমঝোতা হলে নির্বাচন অধিক সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা সম্ভব হবে বলে মত দেন সিইসি। যদিও শুরু থেকেই তিনি রাজনৈতিক সমঝোতার তাগিদ দিয়ে আসছেন। সূত্র : জাগোনিউজ