শনিবর, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, সময় : ০৩:১১ am
আজ ৮ই মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে মহিলাদের কৃতিত্বকে স্বীকৃতি জানানোর জন্য এই দিনটি পালিত হয়।
প্রথমবার ১৯৯৬ সালে নির্দিষ্ট থিমে পালিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক নারী দিবস। জাতিসংঘ ২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’। এই মূল প্রতিপাদ্যের আলোকে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’।
নারীর জয়যাত্রা এখন সর্বত্রই। কোথায় নেই নারীর পদচারনা। নারী তার আপন মেধা-যোগ্যতায় স্থান করে নিচ্ছে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও শান্তিরক্ষা মিশনসহ সর্বক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমন্বয়ে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ইসলামের ইতিহাস আলোকপাত করলেও দেখা যায়, ইসলামের প্রথম যুগে আরবের মহিলারাও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। জ্ঞান অর্জনে পন্ডিত ও কবি হিসেবেও তারা সুখ্যাতি লাভ করেছিলেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সহধর্মিণী হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা শিক্ষা ও সাহসের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে ছয় বা সাত জন সাহাবাকে জ্ঞানের প্রথম শ্রেণিতে গণ্য করতেন তাদের মধ্যে বিবি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন অন্যতম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার অসাধারণ জ্ঞানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা ইসলামের অর্ধেক জ্ঞান বিবি আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নিকট শিক্ষা করবে।’ হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার বাগ্মিতা সম্পর্কে আমির মুয়াবিয়া (রা.) বলেন- ‘আমি আয়েশার তুলনায় অধিকতর মার্জিত কোন বক্তার বক্তৃতা কখনও শুনিনি।’
ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরব দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুসলমান মহিলারা পর্দা রক্ষা করে জমিতে চাষাবাদ, পশুপালন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পত্নী হজরত আয়েশা (রা.) যুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। প্রিয়তমা কন্যা হজরত ফাতেমা (রা.) মুসলিম যোদ্ধাহতদের সেবা-শুশ্রুষা করেছেন।
হজরত আয়েশা (রা.) ও হজরত উম্মে সালমা (রা.) ওহুদ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মহানবী (সা.)-এর ফুফু হজরত সুফিয়া বিনতে আবদিল মুত্তালিব রাদিয়াল্লাহু আনহা খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মুল খায়ের, জুরকা বিনতে আদি, ইকরামা বিনতে আতরাশ ও উম্মে সিনান অসংখ্য যুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক কাজে সহযোগিতা করেন।
উম্মে আতিয়া আনসারি (রা.) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাতটি যুদ্ধে অংগ্রহণ করেন। উমাইয়া বিনতে কায়েস কিফারিয়া খায়বর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। উম্মে হাকিম বিনতে হারিস রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কন্যা হজরত ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, দৌহীত্র-কন্যা সাকিনা খাতুন, হজরত আলীর কন্যা যারকা, ইয়াযিদ আনসারির কন্যা আসমা ও নজদের অধিবাসী খান্সাসহ বহু আরব মহিলা কবি, বক্তা, পন্ডিত ও জ্ঞানী হিসেবে দেশে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তথাকথিত আরব সংস্কৃতিতে সেই নারী সমাজের অবদান অসাধারণ ছিল। বিশ্ব দরবারে মুসলমান জাতির জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নে মুসলমান নারী সমাজের অবদান অবিস্মরণীয়।
হারুন অর রশিদের সময়ে আরব রমণীগণ অশ্ব পৃষ্ঠে আরোহণ করে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন। মুসলিম মহিলারা জ্ঞান-বিজ্ঞানে লব্ধ-জ্ঞান পুরুষের পাশাপাশি কর্ম-ক্ষেত্রে প্রয়োগে নিজেদের কৃতিত্বের গৌরবোজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন।
উম্মে আম্মারা রাদিয়াল্লাহু আনহু উহুদের যুদ্ধে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার যে পরিচয় দিয়েছেন, ইতিহাসে তা চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবে। যুদ্ধের একপর্যায়ে কাফেররা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্ত্রশস্ত্রসহ ঘেরাও করে ফেললে উম্মে আম্মারা তরবারি হাতে সিংহের মতো শত্রুর ব্যূহ ভেদ করে সামনে এগিয়ে যান। শত্রুর তরবারি থেকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রক্ষার জন্য বীরদর্পে অস্ত্র চালনা করেন। রণক্ষেত্রে তার বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিতে গিয়ে স্বয়ং মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ডানে-বাঁয়ে যেদিকে তাকিয়েছি, উম্মে আম্মারাকে আমি আমার চারপাশে যুদ্ধ করতে দেখেছি।
মুসাইলামার বিরুদ্ধে যে সৈন্য বাহিনী প্রেরিত হয়েছিল তার অন্যতম যোদ্ধা ছিল হজরত নাসিবা রাদিয়াল্লাহু আনহা। তিনি তার পুত্র হাবিব বিন জায়েদকে নিয়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে অত্যন্ত মর্মান্তিকভাবে মুসাইলামাতুল কাজ্জাব তার প্রিয় পুত্রকে শহীদ করে। এরপর নাসিবা রাদিয়াল্লাহু আনহা শপথ করেন যে মুসাইলামা জীবিত থাকতে তিনি গোসলের পানি স্পর্শ করবেন না। সে যুদ্ধে তিনি অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করেন। যুদ্ধ শেষে যখন ফিরে আসেন তখন তার শরীরে তরবারি ও বর্শার বারোটি আঘাত ছিল। এমনকি এ যুদ্ধে তিনি একটি হাতও হারান।’ (উসদুল গাবাহ) মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে পর্দা পালন করে শুধু মহিলা সাহাবিরা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে যুদ্ধেই যেতেন না বরং বিভিন্ন কাজে অংশ নিতেন। মুজাহিদদের পানি পান করাতেন, তাদের সেবা-শুশ্রুষা করতেন, যুদ্ধে নিহত ও আহত ব্যক্তিদের মদিনায় পৌঁছানোর কাজে সাহায্য করতেন। আহতদের ক্ষতস্থান ব্যান্ডেজ করে দিতেন এবং অসুস্থদের চিকিৎসা ও সেবা করতেন।
তাই কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন-
‘কোনো কালে একা হয়নি ক’জয়ী পুরুষের তরবারি
প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়ালক্ষী নারী।’
তাই আসুন, অঙ্গীকার করি আর নয় নারীর প্রতি অবিচার ও বৈষম্য, সবাই মিলে নারী-পুরুষ সমতার মাধ্যমে নতুন বিশ্ব গড়ি আর দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করি। সূত্র : জাগোনিউজ, লেখক :